চিকিৎসাবিজ্ঞানের যাবতীয় চেষ্টাই তো জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা, মৃত্যুকে সরিয়ে রাখা দূরে। কিন্তু কথা এই যে জীবন একটি সুন্দর মিথ্যা আর মৃত্যু একটি নিষ্ঠুর সত্য। আমরা অনেক রোগকে প্রতিরোধ করতে পারি, অনেক রোগের চিকিৎসা করতে পারি। কিন্তু জীবনের একটা পর্যায় আসে যখন বার্ধক্য অথবা দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে চিকিৎসাশাস্ত্রের যাবতীয় জ্ঞান, প্রযুক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও মানুষকে বরণ করে নিতে হয় মৃত্যু। চিকিৎসাবিজ্ঞান আর চিকিৎসকেরা রোগের সঙ্গে লড়াই করতে শেখেন মূলত কিন্তু যখন সে লড়াইয়ে তাঁর হার নিশ্চিত, তখন এ বিষয়ে দুঃসংবাদটি রোগীকে দেওয়ার পর তাঁর আর কী করণীয়, এ বিষয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র ছিল তুলনামূলকভাবে অপ্রস্তুত। এই শূন্যস্থান পূরণ করতেই বিকাশ ঘটে ‘প্যালিয়াটিভ মেডিসিন’ নামের চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশেষ শাখা। একে বলা যেতে পারে মৃত্যুপথযাত্রীর উপশমের সেবা। আজ ১২ অক্টোবর বিশ্ব প্যালিয়াটিভ কেয়ার দিবস।
প্যালিয়াটিভ মেডিসিন বিষয়টি বাংলাদেশের রোগী এমনকি অধিকাংশ চিকিৎসকের কাছে এখনো বিশেষ স্পষ্ট নয়। যখন অনুধাবন করা যায় যে বার্ধক্যের কারণে বা বিশেষ কোনো দুরারোগ্য রোগ থেকে রোগীর আর সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন দুই ধরনের পদক্ষেপ নেন অধিকাংশ চিকিৎসকই। হয় তাঁরা কোনো ফল নেই জেনেও নানা রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং ওষুধপথ্য দিতে থাকেন একধরনের সান্ত্বনার চিকিৎসা হিসেবে অথবা রোগীর আত্মীয়স্বজনকে বলেন, ‘আর কিছু করার নেই, এবার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রোগীকে ভালো–মন্দ কিছু খাওয়ান আর আল্লাহ বা ভগবানের নাম নেন।’ প্যালিয়াটিভ মেডিসিনের দৃষ্টিকোণ থেকে দুটো পদক্ষেপই ভুল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি মনে হয় একটি রোগ অনিরাময়যোগ্য, ইংরেজিতে যাকে বলে ইররিভাসেবল, তখন অহেতুক শুধু আশা জাগিয়ে রাখার জন্য নানাবিধ চিকিৎসার চেষ্টা না করে অবধারিত মৃত্যুর জন্য রোগী এবং তার আত্মীয়পরিজনকে প্রস্তুত করা জরুরি। আর মৃত্যু যখন আসন্ন তখন ‘আর কিছু করার নেই’ কথাটিও অসত্য। মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যও করার আছে নানা কিছু। মৃত্যুকে মানুষ এড়াতে পারে না সত্য, কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রার নানা কষ্ট লাঘব করে মৃত্যুকে সহনীয়, সম্মানজনক, কষ্টমুক্ত করতে পারে।
প্যালিয়াটিভ কেয়ার আসন্ন মৃত্যুর বিবিধ কষ্ট উপশম করারই বিজ্ঞান। প্যালিয়াটিভ মেডিসিনের পথিকৃৎ যুক্তরাজ্যের চিকিৎসক সিসিলি সনডার্স মৃত্যুপথযাত্রীর কষ্টকে চারভাগে ভাগ করেছেন। যথা: শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক। তিনি একে বলেছেন ‘টোটাল পেইন’। কী করে মৃত্যুপথযাত্রীদের এই টোটাল পেইন বা সামগ্রিক কষ্ট লাঘব করা যায়, তারই নানা পথপদ্ধতি খুঁজে নেয় প্যালিয়াটিভ কেয়ার। একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগী বা রোগিণীর শারীরিক নানা যে কষ্ট আছে তার নিরাময় না হলেও ব্যথামুক্তির ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, ছোটখাটো ব্যায়াম ইত্যাদির মাধ্যমে তার উপশম সম্ভব। জীবনের অন্তিম সেই সময়গুলো শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি আছে বিবিধ মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক কষ্ট।
জীবনের অন্তিম মুহূর্তে মানুষ তার যাপিত জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া, নিকটজনের সঙ্গে, ধর্মবিশ্বাসভেদে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার সুযোগ যদি পায়, তাহলে তার মৃত্যু অনেক সহনীয় হয়ে ওঠে। প্যালিয়াটিভ কেয়ার রোগীর সেই মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক কষ্ট লাঘবেরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। মানুষের মুমূর্ষুকালের শারীরিক দুর্ভোগ, মানসিক নিঃসঙ্গতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক প্রত্যাশাকে মোকাবিলা করার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিই প্যালিয়াটিভ কেয়ার। এই মোকাবিলা শুধু যিনি মুমূর্ষু তার জন্য নয়, তার আত্মীয়–পরিজনের জন্যও জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্যালিয়াটিভ কেয়ারকে সংজ্ঞায়িত করছে এভাবে ‘প্যালিয়াটিভ কেয়ার জীবন সংশয়ী রোগে আক্রান্ত রোগী এবং আর নিকট পরিজনের জীবনকে উন্নত করার একটি পদ্ধতি। মুমূর্ষু রোগীর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক কষ্টের মাত্রাকে নির্ধারণ করে বিবিধ সেবার মাধ্যমে তার প্রতিরোধ এবং নিরাময় করাই এর লক্ষ্য।’ প্যালিয়াটিভ সেবা দেওয়ার জন্য তাই চিকিৎসাশাস্ত্রের পাশাপাশি প্রয়োজন সমাজবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্বেরও জ্ঞান। চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স এবং নিকট পরিজন মিলিয়ে যৌথভাবে প্যালিয়াটিভ সেবা দেওয়া হয়। পাশ্চাত্যে মূলত হাসপাতালভিত্তিক প্যালিয়াটিভ কেয়ার হলেও তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে কমিউনিটিভিত্তিক প্যালিয়াটিভ কেয়ার দেওয়া হয়।
পৃথিবীব্যাপী মানুষের গড় আয়ু বাড়ার কারণে বর্তমান বিশ্বে প্যালিয়াটিভ কেয়ার অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্যালিয়াটিভ কেয়ার পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। ২০১৫ সালে দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স সংস্থা বিশ্বব্যাপী ৮০টি দেশের প্যালিয়াটিভ কেয়ার পরিস্থিতির মানের একটি তুলনামূলক তালিকা প্রস্তুত করে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৯তম। নিপোর্ট পরিচালিত ২০১৩–এর একটি গবেষণামতে, বাংলাদেশে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ হলেও প্যালিয়াটিভ সেবা পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৫০০ জন। সেই একই গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশের বেশিসংখ্যক ডাক্তারের প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিষয়ে কোনো ধারণা নেই। ২০০৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালিয়াটিভ কেয়ারের একটি ছোট ইউনিট চালু হয় এবং ২০১৫ সালে তাদের তত্ত্বাবধানে কমিউনিটিভিত্তিক প্যালিয়াটিভ কেয়ারের একটি প্রকল্পও চালু হয়। এর বাইরে বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল এবং সংস্থার ত্বত্তাবধায়নেও প্যালিয়াটিভ কেয়ার দেওয়া হয়। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা নেহাতই যৎসামান্য। বেসরকারি পর্যায়ের প্যালিয়াটিভ কেয়ারের খরচও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অথচ বাংলাদেশে নানা রকম দুরারোগ্য রোগে ভোগা মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্যালিয়াটিভ কেয়ারের ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনে রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি হয়ে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে পরিবারকে। পরিবার ছোট হয়ে এসেছে এখন, বাংলাদেশের বহু মানুষ হয়েছেন প্রবাসী—এসব কারণে পরিবারের বার্ধক্যপীড়িত মা–বাবা বা অন্য কোনো সদস্য কোনো রকম যথার্থ সেবা ছাড়াই রয়েছেন শয্যাশায়ী। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সুলভে প্রাতিষ্ঠানিক এবং কমিউনিটিভিত্তিক প্যালিয়াটিভ কেয়ারের বিকাশ জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্ব প্যালিয়াটিভ কেয়ার দিবসে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবার নজরে আসুক। (স্থানাভাবে উল্লেখিত রেফারেন্সগুলো দেওয়া হলো না, যোগাযোগ সাপেক্ষে সরবরাহ করা হবে।)
শাহাদুজ্জামান: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং লেখক
[email protected]