‘কৌরবদের আমি মারিয়াই রাখিয়াছি, অর্জুন নিমিত্তমাত্র’—শ্রীকৃষ্ণের এই কথার মর্মার্থ ‘বোন টু বোন’ অর্থাৎ হাড়ে হাড়ে আরও একবার টের পাওয়া গেল পাটুরিয়ার ঘাটে এসে ফেরি ডোবার পর। জাতি টের পাচ্ছে, আর কিছু না হোক, শ্রীকৃষ্ণের অন্তত এই বাণীটা বেশ কড়াভাবে আত্মস্থ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তারা নিজেরাই এমন সূক্ষ্ম ও মিহি আয়োজন পাতিয়ে রেখেছে যে অঘটন না ঘটার কোনো সুযোগই আর নেই। দুর্ঘটনা এখন ‘নিমিত্তমাত্র’।
ঘটনা সংঘটনের পর ‘সকলই তারই ইচ্ছা’ বলে যথারীতি সেটির গায়ে ‘দুর্ঘটনা’র স্বীকৃতিসূচক সিলমোহর মেরে ‘মহাশক্তিশালী তদন্ত কমিটি’ গঠন নতুন কিছু নয়। দিন কয়েকের মধ্যে সেই কমিটির নিঃশব্দ পরলোকগমনের শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যও সগৌরব বহাল আছে। সুতরাং পাবলিকের মরণ ছাড়া গতি নেই, দুর্গতিও নেই।
গত বুধবার যে ফেরিটি ডুবেছে, তার নাম ‘শাহ আমানত’। বয়স ৪০ বছরের বেশি। তার মেয়াদ শেষ হয়েছে। মানে সেটি ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ছিল। ৪৮০ টন ওজনের মেয়াদোত্তীর্ণ শাহ আমানতকে টেনে তোলার জন্য যে উদ্ধারকারী জাহাজ পাঠানো হয়েছে, সেটির আবার ৬০ টনের বেশি ওজনদার কিছু টেনে তোলার শক্তি নেই। উদ্ধারকারী এই জাহাজের নাম ‘হামজা’। হামজা নিজের দৌড় কতটুকু, তা ভালো করে জানে বলে ফেরি ধরে টানাটানি করেনি। সে ফেরির সঙ্গে ডুবে যাওয়া ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-মোটরসাইকেল টেনে তোলার কাজ করছে। সামান্য কাভার্ড ভ্যান তুলতে গিয়ে হামজার দড়ির কাছি দুইবার ছিঁড়েছে। কারণ, হামজা নিজেও ক্লিনিক্যালি ডেড।
হামজাকে কেনা হয়েছিল ৫৭ বছর আগে। সেই ১৯৬৪ সালে। তার অর্থনৈতিক বয়স পার হয়েছে বহু আগে। শাহ আমানতকে তোলার জন্য আরেক উদ্ধারকারী জাহাজ পাঠানোর কথা শুনছি দুদিন ধরে। তার নাম ‘প্রত্যয়’। ২০১৩ সালে কেনা প্রত্যয়ের নামের মধ্যে যতই ‘হ্যাডম’ থাকুক, আসলে আড়াই শ টনের বেশি ওজন তোলার ক্ষমতা তার নেই। তারও ফিটনেস সনদ হালনাগাদ নেই। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রত্যয় এখনো পাটুরিয়ায় পৌঁছায়নি।
গত বছরের জুনে শ্যামবাজার এলাকায় ডুবে যাওয়া এক লঞ্চকে উদ্ধার করতে গিয়ে এই প্রত্যয় নিজেই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল। পোস্তগোলায় এসে বুড়িগঙ্গা সেতুর পিলারে গুঁতা মেরেছিল সে। আনন্দের খবর, সর্বশেষ ঘটনায় সে নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সেতুর পিলারে ঘাই-গুঁতা মারেনি।
এর বাইরে দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ আছে। তাদের একটির নাম ‘রুস্তম’, আরেকটির নাম ‘নির্ভীক’। ১৯৮৩ সালে কেনা রুস্তমের অর্থনৈতিক বয়স পার হয়ে গেছে। আর ২০১৩ সালে কেনা নির্ভীকের ফিটনেস সনদ হালনাগাদ নেই। এই ক্লিনিক্যালি ডেড ও ফিটনেসবিহীন উদ্ধারকারীরা একজোট হয়ে চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ ৬২০ টন ওজনের নৌযান তুলতে পারবে। তার মানে, উদ্ধারকারীদেরই এখন উদ্ধার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, বিশাল আকারের সাত–আট শ টনের লঞ্চ বা অন্য নৌযান বানানো হচ্ছে। এতে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর হিসাবে, গত ১১ বছরে নৌযান ডুবেছে ৩৮৭টি। উদ্ধার করা গেছে ২২১টি। ১৮১টি নদীর মধ্যে পড়ে আছে।
ঢাকা-বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌরুটের বিলাসবহুল যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোর ওজন ৭০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পর্যন্ত। এর কোনো একটি যদি ডুবে যায়, তাহলে তা হামজা, রুস্তম, প্রত্যয় নির্ভীক—একজোট হয়েও উদ্ধার করতে পারবে না।
তার মানে, আমাদের সামনে বাস্তবতা হলো—একের পর এক লঞ্চ-ফেরি ডুববে।
সেগুলো উদ্ধার করতে হামজা-রুস্তমদের সাহায্য চাওয়া হবে। দিন দুয়েক চেষ্টার পর হামজা-রুস্তমেরা বলবে ‘সরি’। আবার লঞ্চডুবি হবে। আবার তাদের সাহায্য চাওয়া হবে। আবার তারা আসবে। আবার তারা বলবে ‘সরি , পারছি না’। অর্থাৎ যার সমাধান দেওয়ার ক্ষমতা নেই, বারবার তাকেই ডাকা হবে।
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প হয়ে যাক:
গ্রামের নাম তালতলা। সেই গ্রামের তালপুকুরের কাদার নিচে পাওয়া গেল তালের আঁটি। একে তো দশ বছরের পুরোনো; তার ওপর ছিল কাদার তলে। ফলে, এই জিনিস যে তালের আঁটি, বোঝার কোনো উপায় ছিল না। দেখতে পাথরের মতো; কিন্তু পাথর না। যিনি জিনিসটি উদ্ধার করেছেন, তার হাত থেকে এর কাছে, তার কাছে যাচ্ছে। কেউ বলতে পারছে না জিনিসটা কী। ঘণ্টা দুয়েক গবেষণা হলো। জিনিসটা কী, সে ফয়সালা হলো না।
ঠিক হলো, গ্রামের ৯৫ বছর বয়সী আবু তালেব তালুকদার সাহেবের কাছে যাওয়া হবে। তিনি এই এলাকার একমাত্র জীবিত ‘বুদ্ধিজীবী’। তালুকদার কোনো কিছুর সমাধান দিতে পারেন না; কিন্তু সমস্যার কথা গভীর মনোযোগে শোনেন। পরে একটা কিছু বলে দেন। সমাধান না পেলেও তাঁর ধানাইপানাই ফয়সালাতেই গ্রামবাসী সান্ত্বনা পায়।
তালুকদার সাহেব গ্রামবাসীর আনা তালের আঁটি হাতে নিয়ে মিনিট বিশেক ঝিম মেরে থাকলেন। উৎসুক চোখগুলো তাঁর সামনে কাতলা মাছের মতো হাঁ করা। তারা চায় সমাধান। তারা জানতে চায়, এই আশ্চর্য জিনিসটা আসলে কী? হাতের ওপর মেলে ধরা জিনিসটার দিকে চেয়ে থাকা তালুকদার সাহেবের মুখে আচমকা হাসির রেখা ফোটে। হাসি বড় হতে থাকে। আরও বড় হয়। আস্তে আস্তে খিক খিক শব্দ ওঠে। শব্দ বাড়তে থাকে। এরপর হা হা হা। তারপর হো হো হো।
এই দৃশ্য দেখে ‘সমগ্র জনতা নিম্নাভিমুখী আলোড়িত জলরাশির কল্লোলের মতো কৌতুকে উচ্ছ্বসিত হইয়া ধ্বনি দিয়া উঠিল’—‘পাইছে...দাদাজান...পাইছে!’
দাদাজান আবার মিনিট দশেকের ঝিমে চলে যান। এরপর তার মুখ থেকে আস্তে আস্তে খুত খুত করে কান্নার শব্দ বেরোতে থাকে। তারপর হাউ হাউ...মাউ মাউ...।
‘কী হলো! কী হলো!’ বলে সবাই আর্তনাদ করে ওঠে।
একজন বললেন, ‘দাদাজান, সারা জীবন সমাধানের জন্য আপনার কাছে আসছি। এমন তো দেখি নাই। আপনে হাসলেন; হাসার পরে কানলেন। এইডার মাজেজা কী দাদাজান?’
তালুকদার তালের আঁটি টেবিলের ওপর রেখে বললেন, ‘দ্যাখ, আমি হাসলাম এই জন্য যে জিনিসটা যে কী, তা আমিও জানি না।’
—‘আর কানলেন ক্যান?’
—‘আমার কান্নায় বুক ফাইট্যা যাইতেছে এই ভাইবা যে আমি মইরা গেলে তোরা সমাধানের লাইগ্যা যাবি কার কাছে?’
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]