টুইন টাওয়ারে হামলার পর বিশ্বরাজনীতিতে যে পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়, তা মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি রাজনীতিকে জনপ্রিয় করতে সহায়তা করেছে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সামরিক শাসন বা একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধেও আমরা একই সঙ্গে ইসলামি রাজনীতিকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখছি। এই গণতন্ত্র আবার ইসলামি চেতনার সঙ্গে আপসমূলক। আমরা কি তবে পুঁজিবাদ ও ইসলামি চেতনার সংমিশ্রণে আদর্শগতভাবে এক নতুন ‘ইসলামি গণতন্ত্র’ ধারার উত্থানের সন্ধিক্ষণে রয়েছি? এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, যারা পুরোপুরি ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করতে চায় বা যারা আরও কঠোর, সেই আইএস, তাদের অবস্থানই–বা কী হবে?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই-সংগ্রামের পথ ধরে ইসলামপন্থী দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে। তুরস্কে ‘টার্কিশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ বা একেপি সর্বাধিক ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে, যারা আদর্শগত দিক থেকে ইসলামি চেতনায় উদ্বুদ্ধ। আফগানিস্তানে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা সরকার একটি সাংবিধানিক ‘লয়া জিরগা’ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, যাতে ইসলামি ও গণতান্ত্রিক উভয় আদর্শের প্রতিফলন আছে। বাগদাদেও দেখা গেছে, জনসমর্থন আছে এমন একটি সাংবিধানিক পথের সন্ধান করা হচ্ছে, যা ইসলাম ও গণতন্ত্র দুইয়ের মিশ্রণ।
‘আরব বসন্তের’ পরও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘ইসলামি গণতন্ত্র’ জনসমর্থন অর্জন করছে। তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলীর দুঃশাসনের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া আরব বসন্ত এবং বেন আলীর শাসনের অবসান ঘটানোর পুরো আন্দোলনে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ইনাহদার কোনো ভূমিকা ছিল না। রশিদ ঘানৌচি, ইনাহদা দলের প্রতিষ্ঠাতা ২০ বছর ধরে তাঁর পরিবারসহ লন্ডনে নির্বাসনে ছিলেন। অথচ আন্দোলনের পর গণতন্ত্রের পথযাত্রায় জনগণের সর্বাধিক ভোট যায় ইনাহদা দলের প্রতি। ২০১১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে দলটি ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ জনসমর্থন অর্জন করে।
তিউনিসিয়ার পরপরই গণতন্ত্রের দাবিতে শাসনব্যবস্থা ও সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন শুরু হয় মিসরে। এই আন্দোলনের ফল হিসেবে অনুষ্ঠিত ২০১১ সালের নভেম্বরে সংসদীয় নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং একই বছর ব্যাপক ভোটে প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন একই দল থেকে। সেনা অভ্যুত্থানে অবশ্য সেই সরকারের পতন হয়েছে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার শাসন ইসলামপন্থী ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে দোদুল্যমান। আরব বসন্তের হাওয়ায় ২০১১ সালের প্রথমার্ধে ইয়েমেনে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার নেতৃত্বে ছিলেন তাওয়াকেল কারমান। কারমান ইসলাহ দলের সদস্য, যাঁর সংযোগ রয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের ইয়েমেন অংশের ও আহমার গোষ্ঠীর সঙ্গে।
মরক্কোতে রাজতন্ত্রের পতন হয়নি ঠিকই, কিন্তু জনগণ যখন সংস্কারের আন্দোলন শুরু করে, রাজা মুহাম্মদ-৬ তখন অন্য স্বৈরশাসকদের মতো (মিসর, লিবিয়া, বাহরাইন, সিরিয়া) বল প্রয়োগে তা দমন না করে আন্দোলনকারীদের দাবির সঙ্গে আপস করেন। রাজা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে মরক্কোর সবচেয়ে বড় বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেন। একজন ইসলামপন্থীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মরক্কো তুলনামূলকভাবে উদারনৈতিক। এরপরও ইসলামি রাজনীতিনির্ভর মুসলিম ব্রাদারহুড সেখানকার জনগণের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য।
অপর রাজতন্ত্র জর্ডানে মরক্কোর মতোই দ্রুত ও দায়িত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আন্দোলন প্রতিহত করে সেই দেশের রাজা শাসন ও আসন দুই-ই রক্ষা করেছেন। ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় আরেক রাজতন্ত্র বাহরাইনে। এখানে শিয়া জনগোষ্ঠী সুন্নি শাসক দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। প্রাথমিকভাবে আন্দোলন সংস্কারের জন্য হলেও সরকার তা দমনে বল প্রয়োগ করে। তাতে আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে যায়। সৌদি আরবের সাহায্যে এক হাজার সৌদি সশস্ত্র বাহিনী এসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে বুঝিয়ে দেয় যে মানচিত্রের আরব উপসাগরীয় অংশে আরব বসন্তের স্থান নেই। কিংবা সুন্নি শাসনের পতন নেই!
সিরিয়ার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। আসাদ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা মূলত সুন্নি মুসলমান, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬০ শতাংশ) জনগোষ্ঠী। সিরিয়ার আন্দোলন সফলতা না পাওয়ার পেছনে বিভিন্ন বিশ্বশক্তির অবদান রয়েছে। একদিকে যেমন সৌদি আরব ও মার্কিন জোট আসাদবিরোধীদের সহায়তা করে যাচ্ছে, এমনকি তারা আইএসের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেও পিছপা হচ্ছে না, অপর দিকে আসাদকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ইরান ও রাশিয়া, যার ফলে পাঁচ বছরের এই সংঘর্ষের অবসান এখনো হয়নি। বরং এই যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্বরাজনীতি প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, স্নায়ুযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে।
পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে (পশ্চিমা বিশ্ব মানচিত্রের যে অংশকে বলে ‘মিডল ইস্ট’ বা বাংলায় মধ্যপ্রাচ্য) ৯/১১ বা ২০১১-পরবর্তী আন্দোলন ও শাসন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেখা যায়, জনগণের মধ্যে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। জনগণ চায় স্বৈরশাসনের পতন। এই দেশগুলোতে ইসলাম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জনগণ চায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও উন্নয়ন। রাজনৈতিক দল বলতে ইসলামপন্থীরাই এসব দেশে সক্রিয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও ইসলামি চেতনা মানুষের মধ্যে উজ্জীবিত ছিল, যার মূল চালিকাশক্তি মুসলিম ব্রাদারহুড। এমতাবস্থায় স্বৈরশাসনের পতনের পর দেশে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবে, নাকি গণতন্ত্র? যেখানে ইসলামপন্থী দলগুলোর প্রতি জনসমর্থন ব্যাপক, সেখানে গণতন্ত্র ইসলামি চেতনার সঙ্গে আপস করে এক মিশ্র সরকারব্যবস্থা তৈরি করছে, যাকে বলা যেতে পারে নতুন ধারার গণতন্ত্র। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের দুরবস্থার সময়ে এসব ইসলামি ও নতুন গণতন্ত্রের ধারা কতটুকু কার্যকর হবে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। অথবা ইসলামি চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে এই নতুন গণতন্ত্র আদর্শগত দিক থেকে ‘গণতন্ত্রের’ সঙ্গে কতটুকু আপস করবে বা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বিশ্বজুড়ে আইএসের আদর্শগত অবস্থান এই নতুন ইসলামি গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্য নিয়ে আইএস গঠিত হলেও তা এখন আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। ত্রাস সৃষ্টিকারী এই দলটির ভয়ংকর মতবাদ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। সিরিয়ায় যুদ্ধের অবসান ঘটলেও আইএস নির্মূল হয়ে যাবে এমন ভাবার কারণ নেই।
আফগানিস্তানে বিকশিত হওয়া তালেবানদের দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হলেও আইএসের বিস্তৃতি ব্যাপক। প্রযুক্তির বিকাশ ও পক্ষপাতি গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। নিজেদের কাজে অর্থ, সমর্থন ও সৈন্য সংযোগের উদ্দেশ্যে আইএস বর্তমানে ইউরোপ সীমান্তেও অনুপ্রবেশ করে ফেলেছে। প্যারিস, বার্লিনের মতো জায়গায় হামলা হচ্ছে। নতুন বছরে সিরিয়ায় যুদ্ধের বিস্তৃতি কিংবা অবসান—দুটোই উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্র কেবল যুদ্ধরত অঞ্চল থেকে তাদের সৈন্য চালকবিহীন ড্রোন দিয়ে প্রতিস্থাপন করে কিংবা দেশ থেকে অবৈধ অভিবাসী বিতাড়িত করে বা মুসলমানদের ওপর কড়া নজর রেখে আইএস নামের এই ফ্রাংকেনস্টাইনের প্রতিশোধের আগুন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। আইএসকে বিশ্বমানবতার শত্রু বিবেচনা করে সবাই মিলে একযোগে প্রতিহত না করতে পারলে এর পরিণতি অনেক ভয়াবহ হবে। ইসলাম ও গণতন্ত্রের সমন্বয় যেসব দেশে ঘটেছে, আইএস সেই দেশগুলোতে তার আদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। সিরিয়ার যুদ্ধ স্থায়ী হলে তাদের যেমন নতুন অর্থ ও লোকবলের দরকার হবে, তেমনি যুদ্ধের অবসান হলেও তাদের পালিয়ে বাঁচার জন্য নিরাপদ জায়গার দরকার পড়বে। উভয় বাস্তবতাই বিশ্বে আরও ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি করার ক্ষমতা রাখে।
আইরিন খান: লেখক ও গবেষক।