ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর হতে সাহায্য করেছে কারা?
ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির চুক্তির বিরোধিতা আগে থেকেই করে আসছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ওই চুক্তি বাতিল করবেন। সেই ঘোষণা ঠিক রেখে গত বছরের মে মাসে ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেন। পাশাপাশি ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন—গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে।
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাতিসংঘ) চুক্তিতে কী ছিল? চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল ইরানের ওপর বিভিন্ন সময় আরোপিত নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। বিপরীতে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করবে। অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা থেকে সরে আসবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো ইরান কবে থেকে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করল? পারমাণবিক কর্মসূচির প্রযুক্তি বা কলকবজা কোথায় পেল ইরান? এর উত্তর জানতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই দিনগুলোতে, যখন ইরানের শাসকের সঙ্গে দহরম-মহরম ছিল ট্রাম্পের পূর্বসূরিদের। রয়টার্স বলছে, ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি সই করে। এরপর ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রই ইরানকে পাঁচ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক চুল্লি সরবরাহ করে। শুধু তা–ই নয়, ওই চুল্লির সঙ্গে ৯৩ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম জ্বালানিও ইরানকে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ৯৩ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। তার মানে তো সেই ১৯৬৭ সালেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কলকবজা ইরানের হাতে তুলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাহলে এখন যুক্তরাষ্ট্রের এত মাথাব্যথা কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণটাও পরিষ্কার। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি সই ও তেহরানকে পারমাণবিক চুল্লি সরবরাহের সময় তেহরানের মসনদে ছিলেন ওয়াশিংটনের মদদপুষ্ট বলে পরিচিত মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি। মদদপুষ্ট বলার কারণ এক বাক্যেই স্পষ্ট হয়—পাহলভির ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইরানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ১৯৫৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত করায় হাত ছিল ওয়াশিংটনের। সেটা পরে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকারও করেছে। পাহলভির ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম দেওয়ার সময় ওয়াশিংটনের নেতৃত্ব কী ভেবেছিল? পাহলভির হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়া নিরাপদ? আসল কথা হলো যুক্তরাষ্ট্রের দালালি করলে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে কোনো দেশের বাধা নেই। আর ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের পর থেকে যেহেতু ইরানের ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধীরা, তাই এই ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া যাবে না। এটাই হলো ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের ইরাননীতির সারকথা।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র কেন? যে ছয় বিশ্বশক্তি ইরানের সঙ্গে সমঝোতা করেছিল, তাদের অতীত কী? মার্কিন মদদপুষ্ট পাহলভি ভালোই সুনজর পেয়েছিলেন যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কাছ থেকে। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ইরানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল ব্রিটিশ এমআই৬। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনটিআই বলছে, ১৯৭৬ সালে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ইউরোডিফের ফ্রান্সে অবস্থিত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্টের ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা কিনতে ১০০ কোটি ডলার দেন পাহলভি। যেখানে ফরাসি সরকারের সায় ছিল।
১৯৭৯ সালে বিপ্লবে পাহলভির পতনের পর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কিছুটা গতি হারায়। এর কারণ হলো পাহলভির সঙ্গে তাঁর পারমাণবিক কর্মসূচির বিজ্ঞানীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এতে বুশেহর পারমাণবিক স্থাপনাসহ সব পারমাণবিক স্থাপনার কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। পরে বিপ্লবপরবর্তী আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির ইরান নতুন করে ভাবতে থাকে। এতে তারা পাশে পায় পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়াকে। এই রাশিয়া আবার ইরানের সঙ্গে সমঝোতাকারী ছয় বিশ্বশক্তির একটি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনটিআই বলছে, ১৯৯২ সালের আগস্টে ইরান রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি সই করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে রাশিয়া ইরানের বুশেহর পারমাণবিক স্থাপনার কাজ সম্পূর্ণ করার ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে গোপনে তেহরানকে গবেষণাগার জন্য চুল্লি, জ্বালানি সুবিধা ও গ্যাস সেন্ট্রিফিউজ প্ল্যান্ট দেওয়ার প্রস্তাব দেয় মস্কো।
মোট কথা, ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির যে যন্ত্রপাতি রয়েছে, সেগুলো কোনো না কোনোভাবে সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন বা পাকিস্তান। কিন্তু মূল উদ্যোক্তা যে যুক্তরাষ্ট্র বা আজকের ট্রাম্পের পূর্বসূরিরা, সেটা নিশ্চিত। সেই যুক্তরাষ্ট্র আজ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নির্মূল করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
তবে হ্যাঁ, পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার যত হবে, বিশ্বমানবতা ততই হুমকির মুখে পড়বে। তাই এর বিস্তার রোধে কাজ করতে হবে পক্ষপাতহীনভাবে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে জাতিসংঘ তথা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) শক্ত হাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]