>
স্বাগত ২০১৭, বিদায় ২০১৬। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরটা কেমন গেল এবং নতুন বছরে আমাদের কী করণীয়, সে নিয়ে বিশ্বের পুরোধা ভাবুক ও নেতারা নিজেদের মত দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের লেখা ও একজনের সাক্ষাৎকার প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে ছাপা হচ্ছে, প্রতিদিন দুটি করে। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের লেখা বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় প্রকাশের একমাত্র অনুমোদনপ্রাপ্ত সংবাদপত্র প্রথম আলো। আজ শেষ কিস্তিতে ছাপা হলো হুয়ান মানুয়েল সান্তোসের সাক্ষাৎকার ও ডোনাল্ড টাস্কের লেখা।
২০১৬ সাল দেশ, মানুষ ও মূল্যবোধের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও সামাজিক ঐক্যের লড়াইয়ের বছর হিসেবে ইউরোপের ইতিহাসে ঠাঁই করে নেবে। এই সময়টা ছিল অনিশ্চয়তার, যখন দৃশ্যমান ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। তবে একই সঙ্গে এটি বাস্তবিক অর্জনের বছরও ছিল।
গত জুন মাসে যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই সবকিছু ছাপিয়ে তিক্ত হয়ে ওঠে। তবে এর পরেও নতুন একটি প্যান-ইউরোপীয় (ইউরোপের সব কটি বা অধিকাংশ দেশ) ঐক্য ইইউয়ের বহিঃসীমান্ত রক্ষায় এবং কানাডার সঙ্গে সমন্বিত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি (কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক অ্যান্ড ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট—সিইটিএ) আমাদের আশা দেখাচ্ছে।
যে সমস্যাগুলোর সঙ্গে ইইউ যুঝছে, তার বেশির ভাগেরই এখনো পুরোপুরি সমাধান করা যায়নি। অভিবাসী সংকট, ইউক্রেনকে নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা এবং অন্যান্য বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি ক্রমাগত আমাদের ঐক্য ও দক্ষতাকে পরীক্ষার মুখে ফেলছে, নতুন বছরেও যা অব্যাহত থাকবে।
২০১৬ সালের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, সামনে বিশাল এক পরিবর্তন আসছে, যার প্রকৃতি হবে উত্তেজনাকর, যদিও এটা এখনো অজানা, তবু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, পরিবর্তনটা আসছে। বাস্তবিকই এখন যে পরিবর্তনগুলো ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে, সেগুলো রাজনৈতিক পূর্বাভাস দেওয়া বিশেষজ্ঞদের বিভ্রান্ত করছে। অনেক দিন পর এমন হলো যে, বাস্তবতা পণ্ডিত ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে নির্মম পরিহাস করল। কথা হচ্ছে, ব্রাসেলসের আবহাওয়ার মতো রাজনীতিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আবহাওয়ার মতো এ ক্ষেত্রেও হতাশকারী ভবিষ্যদ্বাণীগুলোই সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।
বর্তমানের রাজনীতিতে যে অবকাঠামোগত পরিবর্তন (একে মহাদেশ থেকে বিশাল এক দ্বীপের সহসা দূরে সরে যাওয়াও বলা যেতে পারে) ঘটছে, তা শুধু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পরাঘাতই (আফটার শক) নয়; এর উৎস ও অস্তিত্ব অনেক গভীরে, যা বেকার তরুণদের ক্ষোভ বা ইউরোপ ও আমেরিকায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি নিশ্চল হয়ে পড়াজনিত মধ্যবিত্ত অসন্তোষের চেয়েও গভীর, যদিও এই বিষয়গুলো বিচক্ষণ ব্যক্তি উপেক্ষা করতে পারবেন না। তবে আমরা অনুভব করতে পারছি, এই ভূকম্পনগুলো আরও বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে: একটা যুগের সমাপ্তি, যে সময়টাকে ইউরোপের জন্য বলা যেতে পারে গুরুত্বপূর্ণ এক স্থিতিশীলতার যুগ।
এটা এমন এক যুগ, যা তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে ৭০ বছর স্থায়ী হয়েছে। প্রথমটি হলো, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা, যা পশ্চিমা সক্ষমতার ভিত্তিতে নির্ধারিত এবং নিয়ম ও চুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা বৈশ্বিক সংঘাতের হাত থেকে ইউরোপকে রক্ষা করে। দ্বিতীয়টি হলো, উদার গণতন্ত্র। আর তৃতীয় স্তম্ভটি হলো ইউরোপীয় সমাজগুলোর তুলনামূলক বিকাশ।
তবে ব্যাপক এই পরিবর্তনের আঁচে আমাদের সন্ত্রস্ত, হতোদ্যম বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লে চলবে না। ইতিহাসবিদেরা ভালোভাবেই জানেন, সংকটের চেয়ে স্থিতিশীলতা কম স্থায়ী ও পরিবর্তনশীল। এই সংকটগুলো (যা প্রাকৃতিক ও অনিবার্য) প্রতিরোধ করা আমাদের ক্ষমতার অতীত। আমরা বর্তমান স্থিতাবস্থা ধরে রাখতে উদ্গ্রীব নই, যেহেতু একটা পর্যায়ে পরিবর্তনের প্রত্যাশা বৈশ্বিক হয়ে উঠলে স্থিতিশীল অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। তাই বলে এই নয় যে, এই পরিবর্তন অবশ্যই দুর্যোগ ডেকে আনবে, আবার আনতেও পারে।
সবকিছুই নির্ভর করছে ঝঞ্ঝাপূর্ণ সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সামষ্টিক সক্ষমতার ওপর। ইইউয়ের মূল ঐক্য ধরে রাখাই হবে এই সক্ষমতার পূর্বশর্ত। আমি মন্ত্রের মতো বারবার এ কথা বলব: ভেতর থেকে ভেঙে পড়া ইইউ কখনোই সমস্যা সমাধানে সমর্থ হবে না, যেমনটা তার সদস্যরাষ্ট্রগুলোও, সবচেয়ে বড় সদস্যসহ, পারবে না।
ইউরোপীয় সংহতির ভিত্তি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে, তাকে আগামী দিনে মূল পরীক্ষার সামনে পড়তে হবে। সংহতি ছাড়া ইউরোপ কখনোই ভবিষ্যতের পরিবর্তনগুলোকে প্রভাবিত করতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সহযোগী হয়ে না উঠে ভুক্তভোগীর কাতারে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। এই শীতল পরিস্থিতি এড়াতে আমাদের আবারও সেই বিষয়টাই খুঁজে বের করতে হবে, যা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করবে, যা আমাদের সবার মাঝেই আছে, যা দৃঢ়তার সঙ্গে আমরা রক্ষা করতে পারব। আমাদের আরও একবার নিজেদের ক্ষেত্র নিরূপণ করতে হবে, ভৌগোলিকভাবে নয়, সভ্যতার ও সংস্কৃতির বিচারে, এমনকি সম্ভবত প্রতীকী অর্থেও।
আজকের দিনে জনগণ, জাতি ও দেশগুলোকে আমরা পুরাকথা আর সরলীকরণের শক্তি আবিষ্কার করতে দেেখছি। এটা সম্ভবত এমন এক রাজনীতির পূর্বাভাস দিচ্ছে, যা আরও নিষ্ঠুর হবে—যা সংস্কৃতির চেয়ে আদিমতার খুব কাছাকাছি কিছু একটা হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, ইউরোপীয় ঐতিহ্যের দীর্ঘমেয়াদি ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আর অনুপম বিষয়গুলোকে অগভীর অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে আলাদা করে ফেলা—ইতিহাসবিদ জ্যাকব বার্কহার্ট যাকে আত্মিক স্বাধীনতা বলে সম্বোধন করেছেন।
সংস্কৃতি ও স্বাধীনতায় আমরা সেই ইউরোপীয় সত্তাকে পুনঃ আবিষ্কার করব। রাজনীতিতে এর অর্থ হলো, পরিবর্তনের জন্য আমাদের প্রস্তুত হওয়া উচিত এই শর্তে যে, এই পরিবর্তন যেন স্বাধীনতার অর্থকে প্রধান মূল্যবোধের মধ্যে সীমিত করে না ফেলে। ইইউয়ের অবকাঠামো পরিবর্তন এবং একীভবনের সীমা বাড়ানোর ব্যাপারে মূল দ্বিধাগুলো সমাধানের আগে স্বাধীনতার মহাদেশ হিসেবে ইউরোপের আদর্শকে অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সবাইকে একমত হতে হবে।
আজকের বিশ্ব বর্বরতায় ভরে উঠেছে, আমরা বুঝতে পারি, স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইউরোপীয়রা তাদের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো তখনই জয় করতে পারবে, যখন এ লড়াইয়ে আপস না করার ব্যাপারে আমরা একমত হব। বর্বরতার উপসর্গ আমাদের আশপাশেই, আমাদের মধ্যে ও নিজেদের ভেতরেই রয়েছে।
আমরা যদি বহির্চাপ ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কাছে আত্মসমর্পণ করি, তাহলে অনাগত পরিবর্তন হয়তো ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উপলব্ধিকে ব্যর্থ করে দেবে: একসঙ্গে ও কেবল একসঙ্গেই সংখ্যাগরিষ্ঠরা আইনের শাসনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, জনগণকে দেওয়া সরকারের স্বাধীনতা ও অধিকার সীমিত করে দিতে পারে। আর এ কারণেই আমাদের ভেতরের বা বাইরের যারাই আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করবে, তাদের সাহসের সঙ্গে এবং ধারাবাহিকভাবে মোকাবিলা করে যেতে হবে।
অনুবাদ: রাজিউল হাসান, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
ডোনাল্ড টাস্ক: ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট।