একটা নাম না জানা গণতান্ত্রিক দেশে ভোট চলছে। নির্বাচনী কেন্দ্রগুলো তৈরি। কিন্তু ভোর থেকে প্রবল বৃষ্টি। ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছে কেউ নেই। মনে হচ্ছিল ভোট ভন্ডুল হবে। বেলা বাড়ার পর বৃষ্টি থামল। ভোটারের স্রোত আসতে শুরু করল। ভোট গোনার পর দেখা গেল, ক্ষমতাসীন ডানপন্থী দল পেয়েছে ১৩ শতাংশ ভোট। মধ্যপন্থী দল পেয়েছে ৯ শতাংশ আর বামপন্থী দল পেয়েছে ২.৫ শতাংশ ভোট। বাকি ৭০ শতাংশ ব্যালট ফাঁকা। তাতে কোনো সিল নেই।
এই ফল দিয়ে সরকার গঠন করা যায় না। ফলে সরকার আবার ভোট দিল। দেখা গেল ভোট আগের চেয়ে বেশি পড়েছে। কিন্তু ৮৩ শতাংশ ব্যালট আগের মতো ফাঁকা। ভোটাররা ব্যালট পেপার যেমন ছিল, তেমন অবস্থায় বাক্সে ফেলেছেন। কাউকে ভোট দেননি। তার মানে ভোটাররা গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ করেছেন।
সরকার ভোটারদের এই কাণ্ডকে প্রতিবাদ হিসেবে দেখল না। সরকার মনে করল একটি সংগঠিত শক্তি ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, যারা শুধু সরকারকেই ভেঙে দিতে চায় না, বরং গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ভেঙে ফেলতে চায়। সরকার এটিকে ‘নির্জলা সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করল এবং প্রায় পাঁচ শ নাগরিককে ধরে আনল। দেশে ‘অরাজকতা চলছে’—এমন একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর জন্য সরকার এবং প্রধান বিরোধী দল একজোট হয়ে নিজেরাই সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ তৈরি করল কিন্তু নাগরিকেরা সেই সরকারি সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে রাস্তায় নামল না। চুপ থাকল। জনগণ সরকারকে ভেঙে দিতে চাইছে মনে করে সরকারই জনগণকে ভেঙে দিতে চাইল।
এটি বাস্তবের কোনো দেশের কোনো সত্যিকার ঘটনা নয়। এটি সাহিত্যে নোবেলজয়ী পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগোর রাজনৈতিক উপন্যাস সিইং–এর গল্পের প্লট। এই উপন্যাসে সারামাগো বুঝিয়ে দিয়েছেন, কাউকে ভোট না দেওয়ার মধ্যেও স্বীকৃতি লুকিয়ে থাকে। মানুষ অমুককে ভোট দিলেন না, কিন্তু তমুককে দিলেন। একজনকে সমর্থন দেওয়া এবং আরেকজনকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে দুজনের অস্তিত্বকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু যদি ভোটার কাউকেই ভোট না দেন, তাহলে তার মানে দাঁড়ায় ভোটার দুজনের কারও অস্তিত্বকেই আর স্বীকৃতি দিতে রাজি নন। নীরবতার মধ্য দিয়ে ভোটার তখন সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন। অর্থাৎ মানুষ যখন ভোটদানে অনুপস্থিত থাকেন, তখন তা অনাস্থা ভোটের শক্তিকেও অতিক্রম করে যায়।
এত মানুষ মরছে তা–ও ‘সে রকম’ সহিংসতা হচ্ছে না। নির্বাচনে এত গুলি ফুটছে, তবু অস্ত্র উদ্ধার অভিযান নেই। কারণ, সরকার জানে, ‘এর পরেও বিশ্বাস, প্রণতি/ এর পরেও ঘুম আসবে চোখে/ এর পরেও বাকি আছে ক্ষতি/ এর পরেও ভোট দেবে লোকে।’
সারামাগোর এ কল্পনানির্ভর উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। কিন্তু বাস্তবে তার ৪১ বছর আগে ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানিতে শ্রমিক আন্দোলন বাঁধভাঙা পর্যায়ে চলে গেলে তখনকার সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছিল, ‘জনগণ সরকারের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে’। সরকার তখন পীড়নের দিকে গিয়েছিল। ওই বছরই বের্টোল্ট ব্রেখট ‘দ্য সলিউশন’ শিরোনামের ছোট্ট একটি কবিতা লিখলেন। তার শেষ লাইনে স্যাটায়ার করে বললেন, ‘উড ইট নট বি ইজিয়ার ইন দ্যাট কেইস ফর দ্য গভর্নমেন্ট টু ডিজলভ দ্য পিপল অ্যান্ড ইলেক্ট অ্যানাদার?’ মর্মার্থ দাঁড়ায়: জনগণের ওপর আস্থা না থাকায় জনগণকে ভেঙে দিয়ে এক নতুন জনগণ নির্বাচন করা কি সরকারের জন্য সহজ হবে না?
সারামাগোর উপন্যাসের মতো বাস্তবে কোনো দেশের মানুষ এখনো ওই মাত্রায় খালি ব্যালটে বাক্স ভর্তি করেননি। কিন্তু বের্টোল্ট ব্রেখটের কবিতার ভাষ্যানুযায়ী জনগণের ওপর সরকারের আস্থা হারানো এবং বিদ্যমান জনগণকে ‘ভেঙে’ এক নতুন জনগণ ‘নির্বাচিত’ করার সরকারি চেষ্টার বহু দৃষ্টান্ত বহু দেশে পাওয়া যাবে। দেশে ইউপি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ ও মারামারি, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও সরকারের যে নির্লিপ্ত ছবি দেখা যাচ্ছে তা সারামাগোর সিইং উপন্যাস এবং ব্রেখটের ‘দ্য সলিউশন’ কবিতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
মোট তিন দফায় ইউপি নির্বাচন হচ্ছে। প্রথম দুই দফায় অর্ধশত লোক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন। তাঁদের কেউ প্রতিপক্ষের অস্ত্রের কোপে, কেউ পিটুনিতে, কেউ গুলিতে মারা গেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘাত দেখা যাচ্ছে। এক পক্ষ দলের মনোনয়ন পাওয়া, অন্য পক্ষ বিদ্রোহী। যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর ভোট হবে। এই ভোট পর্যন্ত আরও অনেক মায়ের বুক খালি হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, সে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে বসে আছে।
মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এম খালেক তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রচারসভায় কর্মীদের বলেছেন, ‘নৌকার সিলটি আমরা টেবিলে দেব আর সদস্যের সিলটি গোপন কক্ষে দেব। এখানে পুলিশ, প্রশাসন, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যাঁরা আছেন, তাঁদের কিছু করার নেই। তাঁদের কিচ্ছু বলার নেই। আমি ভোট দেব টেবিলে দেব, ওপেন দেব। যদি প্রশাসন বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আমরা লন্ডনে থাকব না। আপনাদের আশপাশেই থাকব। ফোন খোলা থাকবে। আপনারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আপনাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং আছেন। আমাদের মন্ত্রী আছেন, এমপি আছেন।’
অন্যদিকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম মণ্ডল গত শনিবার বলেছেন, ‘ওনাকে (স্বতন্ত্র প্রার্থীকে) এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না, ভোটকেন্দ্রে ওনার কোনো এজেন্ট থাকবে না। আমরা গোয়ালন্দে করেছি। নৌকার সঙ্গে যারা মীর জাফরি করেছে, তাদেরকে আর গোয়ালন্দে থাকতে দেই নাই।’
অবস্থা দেখে ১৪ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, নির্বাচন এখন আইসিইউতে আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে। অবশ্য তাঁর কথাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ‘শালীনতাবহির্ভূত’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ইউপি নির্বাচন ঘিরে ‘সে রকম’ কোনো সহিংসতা হচ্ছে না।
জনগণ এসব নেতা ও কর্মকর্তার কথা শুনছে এবং বাস্তব চিত্রের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখছে। এত মানুষ মরছে তা–ও ‘সে রকম’ সহিংসতা হচ্ছে না। নির্বাচনে এত গুলি ফুটছে, তবু অস্ত্র উদ্ধার অভিযান নেই। কারণ, সরকার জানে, ‘এর পরেও বিশ্বাস, প্রণতি/ এর পরেও ঘুম আসবে চোখে/ এর পরেও বাকি আছে ক্ষতি/ এর পরেও ভোট দেবে লোকে।’
তারপরও ‘কিন্তু’ থেকে যাবে। এই অন্যায্য হানাহানি, এই ভোটহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন দেখতে দেখতে তিতিবিরক্ত হয়ে জনগণের মাথায় যদি কোনো দিন সারামাগোর উপন্যাসের জনগণ ভর করে, তাহলে সেদিন অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin 20003 @gmail.com