ইউক্রেন সংকট কি ইউরোপে ঐক্য ফেরাচ্ছে

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ইউরোপের নিরাপত্তাকে কতটুকু হুমকিতে ফেলবে, তা নিয়ে গতকাল ফ্রান্সের স্ট্রসবুর্গে অবস্থিত ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে আলোচনা হয়। সেখানে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বক্তব্য দেনছবি: এএফপি

একবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে যুদ্ধ বাধবে—অল্প কিছুদিন আগেও এ ধারণা কল্পনায় আনা যেত না। কিন্তু এখন তা আর কল্পনাতীত কিছু নয়। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাবে কি না, তা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে জল্পনাকল্পনার পর ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) চালানো প্যান-ইউরোপিয়ান জরিপে দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরদাতা মনে করছেন, এই একুশ শতকেই একটি যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আশঙ্কাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে আগেভাগেই ইউরোপের যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

দেখা যাচ্ছে, ইউরোপের একেক দেশের মধ্যে একেক ধরনের ভয় কাজ করছে। নিজ নিজ সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার ওপর তাদের এ ভয়ের ধরন নির্ভর করছে। পোল্যান্ডের ভয়, তার সীমান্ত দিয়ে বেলারুশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অভিবাসীদের ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। পোল্যান্ডের মধ্যে নতুন উদ্বাস্তু প্রবাহের উচ্চতর ভয় কাজ করছে। ফ্রান্স এবং সুইডেনের কাছে সাইবার আক্রমণ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দুটি দেশের জাতীয় নির্বাচনে রাশিয়ার সাম্প্রতিক অনলাইনভিত্তিক হস্তক্ষেপই তাদের উদ্বেগের প্রধান কারণ। অন্যদিকে তেল, গ্যাসসহ সব ধরনের জ্বালানির অভাব জার্মানি, ইতালি এবং রোমানিয়ার জন্য বড় ভয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।

তবে ইউরোপীয়রা বাইরের হুমকি সম্পর্কে যতটুকু ধারণা পোষণ করে থাকে, আদতে তারা তার চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে আছে। মহান জার্মান কৌশলবিদ কার্ল ভন ক্লজসেভিৎস যুদ্ধকে রাজনীতির ভিন্নতর ধারাবাহিকতা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তার আলোকে ইউক্রেন সংকটের প্রথম দিককার সপ্তাহগুলোতে ইউরোপের দেশগুলো কীভাবে যুদ্ধ-হুমকির প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল, তা অনুধাবন করলে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে।

যুক্তরাজ্যের কথাই ধরা যাক। অনেকেই মনে করেন, ইউক্রেনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সদিচ্ছা থেকে নয় বরং লকডাউনের মধ্যে ডাউনিং স্ট্রিটে পার্টির আয়োজন করায় বিরক্ত দেশবাসীর মনোযোগ অন্য দিকে ঘোরাতেই পূর্ব ইউক্রেনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আকস্মিক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া ব্রেক্সিট–পরবর্তী ব্রিটেন যে এখনো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রমাণ করার একটা মোক্ষম মওকা এনে দিয়েছে ইউক্রেন সংকট—এমনটাই বরিস জনসন মনে করছেন বলে জনমনে ধারণা হয়েছে।

যুদ্ধ যে ইউরোপে আর কল্পনাতীত বিষয় নয়, সেটিই ইউরোপীয়দের সম্মিলিত শান্তি রক্ষার জন্য আপস করতে ও এক ছাতার তলায় আসতে বাধ্য করতে পারে। ইউক্রেনের সীমান্তে সেনা জড়ো করার সময় পুতিন বুঝতে পারেননি তিনি অজান্তেই ইইউ সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে একটি ঐক্যের দিকে ধাবিত করছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক নম্বর লক্ষ্য হলো সংকট মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থান এবং সময়—উভয়কেই যথাসম্ভব হ্রাস করা। দায়িত্ব গ্রহণের পর বাইডেনের লক্ষ্য ছিল আমেরিকার মধ্যবিত্ত উপকৃত হবে এমন নীতি কার্যকর করা এবং মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ফোকাস ইন্দো-প্যাসিফিক এবং চীন দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জের দিকে স্থানান্তর করা। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন, এটিও আমেরিকার গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি। এ কারণে এসব দিকেই বাইডেনের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে।

ইউক্রেন ইস্যুতে আমেরিকার বর্তমান অবস্থান পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের সরকারগুলোর জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে আমেরিকার বিদ্যমান অবনতিশীল রাজনীতি এবং জো বাইডেনের প্রশ্নবিদ্ধ সংকল্প নিয়ে এই দেশগুলো ক্রমে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয় হলো, যদি যুক্তরাষ্ট্রের নির্লিপ্ততার মধ্য দিয়ে রাশিয়ান ট্যাংকগুলোকে ইউক্রেনে ঢুকতে দেওয়া হয়, তাহলে রুশ বাহিনীর পরবর্তী গন্তব্য তালিন (এস্তোনিয়ার রাজধানী), রিগা (লাটভিয়ার রাজধানী), এমনকি ওয়ারশও (পোল্যান্ডের রাজধানী) হতে পারে।

আরও পড়ুন

এদিকে জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া এবং গ্রিসের মতো দেশগুলোর আশঙ্কা, ইউক্রেনের ওপর আঘাত রাশিয়ার সঙ্গে তাদের অধিকতর স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেবে। সব মিলিয়ে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে নানা ইস্যুতে মতবিরোধ আছে। তবে ইউরোপে আরেকটি যুদ্ধ প্রতিরোধ করার ইচ্ছা; ন্যাটোর বিশ্বাসযোগ্যতা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এবং ইউক্রেনকে রাশিয়ার জোয়ালের নিচে বাধ্য করা থেকে বাঁচানোর দায়িত্ববোধ—এ তিন ইস্যুতে তারা মোটামুটি একমত।

এটিই এখন আশার কথা। ভালো খবর হলো, ইউরোপীয় সরকারগুলো তাদের নিজেদের ভেদাভেদ দূর করার পন্থা খুঁজছে। যদিও মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় অনেক দেশ রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করছে। তবে তারা রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার একটি পথ খুঁজে বের করার বিষয়ে জো বাইডেন ও এমানুয়েল মাখোঁর চেষ্টায় বাধাও দেয়নি। প্রাথমিক দ্বিধা এবং নীরবতার পরে জার্মানি ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা সব বিষয় টেবিলে বসে সুরাহা করতে ইচ্ছুক।

যুদ্ধ যে ইউরোপে আর কল্পনাতীত বিষয় নয়, সেটিই ইউরোপীয়দের সম্মিলিত শান্তি রক্ষার জন্য আপস করতে ও এক ছাতার তলায় আসতে বাধ্য করতে পারে। ইউক্রেনের সীমান্তে সেনা জড়ো করার সময় পুতিন বুঝতে পারেননি তিনি অজান্তেই ইইউ সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে একটি ঐক্যের দিকে ধাবিত করছেন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক