ইউক্রেন নিয়ে বাইডেনের চাপ সামলাচ্ছেন মোদি

বাইডেনের চাপও বন্ধুত্ব টলাতে পারেনি। ২০১৮ সালে রাশিয়ার সোচিতে নৌবিহারে মোদি ও পুতিন
রয়টার্স

ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ করা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ওয়াশিংটনের প্রতি দিল্লির ঐতিহাসিক অভিযোগ-অনুযোগকে নতুন করে সামনে এনেছে। অন্যদিকে, এই যুদ্ধের জেরে রাশিয়া ও চীনের মতো বড় শক্তির নয়াদিল্লির দ্বারস্থ হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে দৃশ্যমান করছে। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকে হোয়াইট হাউস রাশিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সমর্থন জোগাড় করার জন্য চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছে এবং কূটনৈতিকভাবে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের খানিকটা হলেও আশা ছিল, ভারত ওয়াশিংটনের এই নিষেধাজ্ঞাগুলোকে মেনে চলবে এবং রাশিয়ার সঙ্গে ভারত দূরত্ব বজায় রাখবে। কিন্তু সেটি হয়নি। নয়াদিল্লি বেশ খোলাখুলিভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলোকে এড়ানোর উপায় অবলম্বন করেছে এবং জাতিসংঘে রাশিয়ার নিন্দা করা থেকেও বিরত থেকেছে।

তবে ইউক্রেন ইস্যুতে ভারত একচেটিয়াভাবে রাশিয়ার পক্ষও নেয়নি। নয়াদিল্লি প্রথম থেকেই সংঘাত নিরসনে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে আলোচনায় বসার জন্য আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ইউক্রেনের সঙ্গে ভারতের আগে থেকেই সম্পর্ক ভালো। এই পরিস্থিতিতে ভারত সেই সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। সে কারণে ভারত তার জোট নিরপেক্ষতার রেওয়াজ ভেঙে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানকে সমর্থনও দেয়নি। ভারতের এই ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব ওয়াশিংটনের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন সংঘাতকে বিচ্ছিন্ন কর্তৃত্ববাদী রাশিয়া ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যবদ্ধ শক্তির দ্বন্দ্ব হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মস্কোর সঙ্গে দিল্লির সতর্ক অথচ টেকসই সহযোগিতামূলক সম্পর্ক, রাশিয়াকে চীনের কূটনৈতিক সহায়তা দেওয়া এবং দক্ষিণ গোলার্ধজুড়ে রাশিয়ার প্রতি বিদ্যমান থাকা সীমান্ত সমর্থন ওয়াশিংটনের সেই ঈপ্সিত চিত্রকে ক্ষুণ্ন করেছে।

গত ১১ এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন একটি যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব লয়েড অস্টিন এবং ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের উপস্থিতিতে ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন বলে অভিযোগ করেন। ব্লিঙ্কেনের ওই মন্তব্যে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিশেষ করে, ওই যৌথ বিজ্ঞপ্তির সময় এই বিষয় নিয়ে ব্লিঙ্কেন কথা বলবেন, এমন কোনো আভাস-ইঙ্গিত মার্কিন কর্মকর্তাদের দিক থেকে আগেভাগে আসেনি বলে ভারতের বিশ্লেষকেরা ব্লিঙ্কেনের তুমুল সমালোচনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে ভারত যে কোয়াডে যুক্ত হয়েছে, সেটি চীনের জন্য সেই মাত্রার আতঙ্ক তৈরি করতে পারেনি। তবে ২০২১ সালে আচমকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া ‘অকাস’ নামের যে নিরাপত্তা জোট গঠন করেছে, সেটি চীনকে সত্যিই উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। অকাস ঘোষণার ধাক্কা স্পষ্টতই চীনকে ভারতের সঙ্গে নরম সুরে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যেহেতু ইউক্রেন যুদ্ধ দৃশ্যত নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা করছে, সেহেতু নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে একটি সমঝোতাপূর্ণ অবস্থানে আসার আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পশ্চিমা বিশ্বে ভারতের গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ নিয়ে তির্যক আলোচনা হয়ে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় ব্লিঙ্কেন এমন মন্তব্য করলেন। ভারতে পশ্চিমের কয়েক শতাব্দীর ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রতি মোদির সমর্থকদের অনেক আগে থেকে যে বিদ্বেষ ছিল, ব্লিঙ্কেনের মন্তব্য সেই বিদ্বেষকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপান–উতরের বিষয়টিকে অন্য শক্তিগুলো সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছে। ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থানকেই রাশিয়া তার প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন ও ওয়াশিংটনের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে গণ্য করছে এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মস্কো ভারতে বিরাট মূল্যছাড়ে তেল রপ্তানি বাড়িয়েছে।

এটি ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা এবং পারমাণবিক জ্বালানি সহযোগিতার সম্পর্ককে জোরালো করেছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি খাতের বাইরে দুই দেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাড়িয়েছে। ভারত বছরের পর বছর ধরে অস্ত্র আমদানির জন্য রাশিয়াকে প্রধান গন্তব্য বানিয়েছে। এটি দুই দেশের সামরিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করছে। যত দিন এই সামরিক সহযোগিতা থাকবে, তত দিন জাতিসংঘে ভারতের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন যে অটুট থাকবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) ভারতকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে রাজি করানোর চেষ্টা করেছে। গত ২৮ মার্চ ইইউ উল্লেখ করেছে, ভারত ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার নিন্দা করতে অস্বীকার করায় ইইউ দিল্লির প্রতি মোটেও ‘সন্তুষ্ট নয়’। অবশ্য ইইউ ভারতের সমালোচনা সীমিত করেছে এবং তার বদলে তারা ভারতের সঙ্গে আরও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ার কৌশলের দিকে মন দিয়েছে।

২০২০ সালে ‘ইইউ-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ: এ রোডম্যাপ টু ২০২৫’ শীর্ষক একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এর পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের এপ্রিলে ‘ইইউ স্ট্র্যাটেজি ফর কো-অপারেশন ইন দ্য ইন্দো-প্যাসিফিক’ শীর্ষক একটি কৌশলপত্র প্রকাশ করা হয়। এই দুটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয় ভারতের সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর সহযোগিতা বাড়ানোর কথা মাথায় রেখে। এক মাস পরে, ভারত এবং ইইউ একটি মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তি গঠন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টায় একটি একটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেছে।

চলতি মাসের গোড়ার দিকে মোদি ইউরোপের তিন দেশ সফর করেছেন। ২ মে বার্লিনে ষষ্ঠ জার্মান-ভারতীয় আন্তসরকার আলোচনা হয়েছে। সেখানে বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ৪ মে কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় ভারত-নর্ডিক শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে। সেখানে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং নরওয়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন সন্ধ্যায় মোদি সদ্য পুনর্নির্বাচিত ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে দেখা করতে প্যারিসে যান। এসব দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ফোরামের মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বৃহত্তর উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে ভারত কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে। এটি ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বর্ধিত চাপ মোকাবিলায় সহায়তা করছে।

ইউক্রেনের সংঘাত চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে কীভাবে পরিবর্তিত করবে, সেটি এখন বিশ্লেষকদের একটি বড় আগ্রহের বিষয়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভারতের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা বেইজিংয়ের নজর এড়ায়নি। ৮০ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে চীনের অনেকবার সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সাল থেকে চীনা এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনী বিতর্কিত সীমান্তের কিছু অংশজুড়ে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে জড়িয়ে আছে। ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা জোটে গাঁটছড়া বাঁধে, তাহলে তা এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে—এমন একটি আশঙ্কা যখন বেইজিংকে পেয়ে বসে, তখনই তারা দিল্লির সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর নীতি গ্রহণ করে থাকে।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে ভারত যে কোয়াডে যুক্ত হয়েছে, সেটি চীনের জন্য সেই মাত্রার আতঙ্ক তৈরি করতে পারেনি। তবে ২০২১ সালে আচমকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া ‘অকাস’ নামের যে নিরাপত্তা জোট গঠন করেছে, সেটি চীনকে সত্যিই উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। অকাস ঘোষণার ধাক্কা স্পষ্টতই চীনকে ভারতের সঙ্গে নরম সুরে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যেহেতু ইউক্রেন যুদ্ধ দৃশ্যত নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা করছে, সেহেতু নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে একটি সমঝোতাপূর্ণ অবস্থানে আসার আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি অন্য সব বড় শক্তির কাছ থেকে সহযোগিতা আকর্ষণ করার পক্ষে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এমনকি চীনের সঙ্গেও ভারতকে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

জন পি রুহেল ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক