ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ইলিশ চঞ্চল হয়। সে সাগর থেকে মোহনা ধরে উজানের দিকে ছোটে। তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী চরিত্র কুবেরের মতো সব ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ান। মহা উৎসাহে তাঁরা জাল ফেলেন। পরিযায়ী পাখির মতো ছুটে চলা ঝাঁক ঝাঁক পরিযায়ী ইলিশ সেই জালে ধরা দেয়। এ কারণে শ্রাবণ-ভাদ্রে বৃষ্টি নামলে বাঙালির জিবে জল আসে। মন (আসলে জিব) চঞ্চল হয়ে ওঠে।
মাস দেড়েক আগে একদিন একপশলা বৃষ্টি নামার পর ইলিশের জন্য মন কেমন করল। ফেসবুকে দেখলাম ‘কুবের’ নামের এক ‘ডিজিটাল পদ্মা নদীর মাঝি’। তাদের ইনবক্সে বললাম, ‘এক কেজি ওজন হবে এমন সাইজের এক জোড়া ইলিশ চাই। দাম কত?’ ‘কুবের’ যে দাম বলল, তাতে জিবের জল সেকেন্ডের মধ্যে শুকিয়ে গেল। প্রশ্ন করলাম, ‘দাম এত কেন?’ জবাব এল, ‘ইলিশ ধরা পড়ছে না। কয়েক দিন পরে ইলিশে বাজার সয়লাব হবে, তখন দাম অর্ধেকের নিচে নামবে। তখন আপনাকে ফোন করে জানাব।’ এরপর মাস দেড়েক পার হতে চলল। কিন্তু ইলিশে বাজার সয়লাব হলো না, দাম ‘অর্ধেকে’ নামল না; ফলে ‘যে টেলিফোন আসার কথা, আসেনি’।
ইলিশ নিয়ে বিরাট দুঃসংবাদ ছেপেছে পত্রিকাগুলো। তারা বলছে, অন্যবারের মতো এ বছর নদ-নদীতে তো নেই-ই, এই ভরা মৌসুমে গভীর সাগরেও ইলিশের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। যা-ও ধরা পড়ছে, তার বেশির ভাগই জাটকা ওরফে ‘খোকা ইলিশ’।
ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণের নদীগুলো বরগুনার পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর এবং ভোলার তেঁতুলিয়া, বুড়াগৌরাঙ্গ হয়ে মেঘনা অববাহিকা থেকে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই নদীগুলো বেয়ে সাগর থেকে ইলিশ উঠে আসে। কিন্তু তাদের উঠে আসার ‘রাস্তায়’ বেহুন্দি, ভাসা, খুঁটাজাল দিয়ে সারা বছর ঘিরে রেখে নির্বিচার মাছের পোনা ধরা হয়েছে। সারা বছর জাল দিয়ে ঘিরে রাখায় এই মোহনার পুরো অংশে কয়েক শ কিলোমিটারজুড়ে ডুবোচর পড়ে গেছে। এ কারণে নদীতে ইলিশ ঢুকতে পারেনি। তারা অভিমান করে সাগরে চলে গেছে। সেখান থেকেও তাদের আমরা তাড়ানোর ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করে ফেলেছি।
টানা ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকার পর জেলেরা ইলিশের খোঁজে সাগরে নেমেছিলেন ৩ আগস্ট থেকে। এ সময় সেন্ট মার্টিন উপকূলে ইলিশ ধরা পড়ছিল ভালোই। সাইজেও ছিল বড়। কিন্তু বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, খুলনা, ভোলায় ইলিশের দেখা মিলছিল না। সেন্ট মার্টিনের কাছে ইলিশ জড়ো হয়েছে শুনে তাঁরা ইলিশের ঝাঁকের মতো ট্রলারের ঝাঁক নিয়ে সেখানকার উপকূল চষা শুরু করলেন। এক জায়গায় এত ট্রলারের দাপাদাপিতে বিরক্ত হয়ে সেখান থেকেও ইলিশ সটকে পড়েছে। এখন সেখান থেকেও জেলেদের খালি ট্রলারে ফিরতে হচ্ছে। এখন একটাই আশা, উপকূল পলাতক এই গভীর জলের মাছ আগামী অক্টোবরে আবার ফিরে আসবে। তারা নদীর মোহনায় ডিম পাড়বে। ডিম ছেড়ে ফেরার সময় এই ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ আমরা নৌকায় তুলতে পারব।
গভীর সাগর থেকে ইলিশকে আমরা যত উপকূলে আসতে বা নদীতে ঢুকতে দেব, তত তার স্বাদ ও গন্ধ বেড়ে যাবে। প্রশ্ন হতে পারে, ইলিশের উঠে আসার সঙ্গে স্বাদ ও গন্ধের কী সম্পর্ক? গবেষকেরা বলছেন, আছে, গভীর সম্পর্ক আছে। তাঁরা বলছেন, সাগরের নোনাপানি থেকে ইলিশ যত নদীর উজানে যেতে থাকে, ততই তার শরীর থেকে আয়োডিন ও লবণের মতো খনিজ পদার্থ ঝরতে থাকে। উজানে ছুটে চলার সময় ইলিশ কিছু খায়ও না। তাই ইলিশ যত বেশি স্বাদুপানিতে থাকতে পারবে, তত তার দেহ থেকে লবণ কমবে। যত লবণ কমবে, তার স্বাদ তত বাড়বে।
ইলিশ নিয়ে বিরাট দুঃসংবাদ ছেপেছে পত্রিকাগুলো। তারা বলছে, অন্যবারের মতো এ বছর নদ-নদীতে তো নেই-ই, এই ভরা মৌসুমে গভীর সাগরেও ইলিশের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। যা-ও ধরা পড়ছে, তার বেশির ভাগই জাটকা ওরফে ‘খোকা ইলিশ’।
তাঁরা বলছেন, ইলিশের অনন্য স্বাদের অন্যতম কারণ হলো স্নেহ পদার্থ বা ফ্যাট। মানে আমরা যেটাকে ‘তেল’ বলি। এই তেল অন্য মাছের পেটের অঙ্কীয়দেশে জমা হয়। কিন্তু ইলিশের ক্ষেত্রে সেই তেল তার সারা দেহে, পেশি-কলা-কোষের পরতে পরতে সুষমভাবে ছড়িয়ে থাকে। সে কারণেই ইলিশের এত স্বাদ। সে যত দৌড়াবে, ততই তার শরীরের বিভিন্ন অংশে তেল পৌঁছাবে আর ততই সামুদ্রিক উপাদান তার শরীর থেকে ঝরবে। এই কারণে ইলিশের পরিযানের হাইওয়েতে কোনো বাধা রাখা যাবে না। তাদের দৌড়াতে দিতে হবে।
স্বাদের ইলিশ পেতে গেলে বলতে হবে, ‘সাইজ ডাজ ম্যাটার’। বুদ্ধদেব বসু যে ইলিশকে নিয়ে রোমান্টিসিজম চর্চা করেছেন, ‘রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে কালো মালগাড়ি ভরা জলের উজ্জ্বল শস্য’ বলে যে শস্যের কথা উল্লেখ করেছেন, তা কিন্তু এই জাটকাকে নিয়ে নয়। ‘রাশি-রাশি ইলিশের শব’, ‘নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড়’ বলতে বুদ্ধবাবু যে ইলিশের কথা বলেছেন, সেসব ইলিশ আকারে বড়ই ছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আসল ইলিশের স্বাদ দেড় কিলো থেকে পৌনে দুকিলোতে।’
এই জাতের তাগড়াই ইলিশ নিয়ে বাঙালির আত্মাভিমান টিকে আছে বহু আগে থেকে। শোনা যায়, আগের দিনে ইলিশপ্রেমীরা নৌকায় করে সোজা পদ্মার বুকে মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলেদের নৌকায় গিয়ে উঠতেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা ভুলেও ইলিশের নাম মুখে আনতেন না। রীতি অনুযায়ী, তাঁরা মাঝির কাছে গিয়ে বলতেন, ‘কী বাবু, হবে নাকি?’ মাঝি তাতেই যা বোঝার বুঝে নিতেন। ‘ইলিশ’ উচ্চারণ করলে মাঝিরা ফিরেও তাকাতেন না। কারণ, তাঁরা ভাবতেন, মৎস্য কুলপতির নাম করলে মীন দেবতা নাখোশ হবেন।
সেই ইলিশে ভর করে আজও বাঙালি কৌলীন্য টিকে আছে। অতি আনন্দের কথা, বিদেশেও এখন ‘ইলিশায়ন’ হচ্ছে। ইউরোপ–আমেরিকার রেস্টুরেন্টে বাঙালি কায়দায় রান্না ইলিশ মহা গর্বে বিকোচ্ছে। প্রতিনিয়ত দেশে কিংবা বিদেশে সে প্রমাণ করে ছাড়ছে, ইলিশ উৎসবের মাছ। এই মাছ একা খাওয়ার মাছ নয়।
তবে ইলিশের হাজার গুণের পাশে একটাই দোষ। সেটা হলো ‘ইলিশ–লোভ’। এই লোভে যে বঙ্গসন্তান পড়েনি, তার বাঙালিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। সব গল্প ফুরায়। ইলিশের গল্প ফুরায় না। আড্ডায় একবার ইলিশের আলাপ উঠলে সবাই সেই গল্পের মুড়ো থেকে ল্যাজা—সব ছাড়িয়ে নেয়। সেই ইলিশ এখন লাপাত্তা। মানা যায়!
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক