কিছুদিন আগেও এমন ছিল, যানজটে কেউ আটকা পড়লে বা আটকে থাকার সময়টা অস্বাভাবিক মনে হলে খোঁজখবর নিতে শুরু করত। কোথাও কিছু হয়েছি কি? কোনো দুর্ঘটনা, কোথাও কোনো বিক্ষোভ সমাবেশ, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বা ছাত্র-শ্রমিকদের কোনো অসন্তোষ? এখন এ ধরনের কিছু ছাড়াই আপনাকে কোনো এক স্থানে ঠায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে। রাস্তার এক পাশ থেকে ইউটার্ন নিয়ে অন্য পাশে যেতে ৪৫ মিনিট লেগে যেতে পারে। এখন যানজটে আটকে থাকার ‘অস্বাভাবিক’ সময় বলে কিছু নেই।
‘অফিসের একটা প্রেজেন্টেশন ছিল বেলা তিনটায়। সারা সকাল প্রেজেন্টেশন বানিয়ে আমি উত্তরা থেকে রওনা দিয়েছি ১২টায়। ধুলা আর গরমে সেদ্ধ হয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বসে আছি তো আছিই। এদিকে অফিস থেকে বস ফোন দিয়েই যাচ্ছে আর দিয়েই যাচ্ছে। তিনটা পার হয়ে সাড়ে তিনটা বাজল। একপর্যায়ে বস বলল, “ঢাকায় জ্যাম আছে তা তো জানেনই, আগে রওনা দেবেন না?”
‘আমি আর কত আগে রওনা দেব? এ টেনশন আমি আর নিতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে আমি দেখলাম আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, আমি কাঁদছি। হেঁচকি তুলে কাঁদছি। কান্না থামছেই না।’
এ অভিজ্ঞতার কথা আমাদের বন্ধু সিমু নাসেরকে ফোন করে বলেছেন তাঁরই এক বন্ধু। সিমু নাসের এটা তাঁর ফেসবুকে শেয়ার করেছেন।
এমন অবস্থায় আমরা প্রতিদিনই কেউ না কেউ পড়ছি। আমরা আসলেই জানি না কত সময় নিয়ে রওনা দিলে গন্তব্যে পৌঁছা যাবে। ২০ মিনিটের রাস্তা লাগতে পারে দুই ঘণ্টা, এক ঘণ্টার পথ লাগতে পারে চার ঘণ্টা। যানজটে পড়ে আমাদের অনেকেরই কাঁদতে ইচ্ছা করে, মনে হয় মাথার চুল ছিঁড়ি। কারও কাছে কিছু চাওয়ার নেই, কারও কাছে অভিযোগ করারও কিছু নেই, এমন একটি সামাজিক পরিস্থিতি আমাদের আরও অসহায় করে তুলেছে। আমরা যানজটে বসে শহরজুড়ে চলা ‘উন্নয়ন’ কাজের ধুলাবালু আর দূষণে ফুসফুস ভরছি, গরমে ঘামছি আর কানের আয়ু কমিয়ে বধির হওয়ার পথে এগোচ্ছি। আমরা শারীরিকভাবে যন্ত্রণার শিকার হচ্ছি, আর ক্ষোভ, দুঃখ ও হতাশা চেপে রেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছি।
ঢাকার যানজটের এখন যা অবস্থা, তাকে আর শুধু যানজট বলার সুযোগ আছে? নাকি এটা দুর্যোগ? উইকিপিডিয়ায় দুর্যোগের সংজ্ঞা দেওয়া আছে এ রকম: দুর্যোগ হলো এমন একটি গুরুতর সমস্যা, যা স্বল্প বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘটে এবং ব্যাপক মানবিক, বস্তুগত, অর্থনৈতিক বা পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। এ দুর্যোগ কখনো প্রকৃতির দান, কখনো মানুষ নিজেই তা তৈরি করে।
এ সংজ্ঞাকে ঠিক ধরলে ঢাকার যানজট ও পরিবেশ পরিস্থিতিকে মানুষ, মানে আমাদের তৈরি দুর্যোগ বলেই মানতে হয়। কোনো অঞ্চল যখন দুর্যোগের মধ্যে পড়ে, তখন তাকে দুর্গত বা উপদ্রুত এলাকা বলে ঘোষণা করার বিধান রয়েছে। আমাদের দেশে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২’ নামের একটি আইন রয়েছে। সেখানেও দুর্যোগের একটি সংজ্ঞা রয়েছে। ‘দুর্যোগ (Disaster) অর্থ প্রকৃতি বা মনুষ্যসৃষ্ট অথবা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে...যাহার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা আক্রান্ত এলাকার গবাদিপশু, পাখি, মৎস্যসহ জনগোষ্ঠীর জীবন, জীবিকা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, সম্পদ ও পরিবেশের এই রূপ ক্ষতি সাধন করে অথবা এইরূপ মাত্রায় ভোগান্তির সৃষ্টি করে যাহা মোকাবিলায় ঐ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সম্পদ, সামর্থ্য ও সক্ষমতা যথেষ্ট নয় এবং যাহা মোকাবিলার জন্য ত্রাণ ও বাহিরের যে কোনো প্রকারের সহায়তা প্রয়োজন হয়…।’
উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নয়নকাজ আমাদের কাছে দৃশ্যমানও হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ঢাকা শহরে এ পর্যন্ত যে উন্নয়ন হয়েছে, তা জনগণকে স্বস্তি দেয়নি। সামনে যেগুলোর কাজ হচ্ছে, সেগুলো শেষ হলে ঢাকাবাসী আরাম পাবে, সেই আশা করা যাচ্ছে না। এমন এক দুর্ভাগ্যের মধ্যে আমরা পড়লাম কেন?
যানজটের কারণে ঢাকার ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রা’ শুধু ব্যাহত নয়, বরং অচল হওয়ার পথে রয়েছে। প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা, জনগণ শিকার হচ্ছে চরম ‘ভোগান্তির’। একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত যে ঢাকার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের ‘সামর্থ্য ও সক্ষমতা যথেষ্ট নয়’। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকা এখন দ্বিতীয় শীর্ষ শহর, বিশ্বে সবচেয়ে কম বাসযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ আর তাজা খবর হচ্ছে শব্দদূষণে ঢাকা এখন বিশ্বের শীর্ষে। এমন একটি শহর ‘দুর্গত’ না হলে কাকে আমরা দুর্গত অঞ্চল বলব!
সমস্যা হচ্ছে ঢাকার এই যে দুর্গত দশা, একে যদি ‘দুর্গত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করতে হয়, তবে সেটা করারও আসলে কেউ নেই। যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. সামছুল হকের ভাষায় যে শহরটি ‘ক্যানসার রোগী’, তার তো কেমোথেরাপি দরকার। সেই কাজটি করবে কে? আমরা কেউ জানি না ঢাকা শহরের এ অবস্থার জন্য আমরা কাকে দায়ী করব। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে, ট্রাফিক পুলিশকে, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে, রাজউককে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে, জেলা প্রশাসনকে, নাকি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে? ঢাকার জন্য অনেকেই আছে, আসলে কেউ নেই।
এই যে এত উন্নয়ন হয়েছে, এর ফল কী? আর যে ‘উন্নয়ন’ এখনো চলছে, তা সামনে আমাদের দুর্ভোগকে কতটা দূর করবে? ঢাকায় সাতটি উড়ালসড়ক হয়েছে। এর প্রসবযন্ত্রণা ঢাকাবাসী মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল, এখন উড়াল দিয়ে আমাদের ওড়া হয় না। সেখানেও আমাদের আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। উড়ালসড়ক যে শহরের ভেতরের যানজট সমস্যার সমাধান দেয় না, তা বিশ্বের অনেক দেশেই এখন প্রমাণিত। আমরা যখন উড়ালসড়ক তৈরির পথ ধরেছি, তখনই অনেক দেশে উড়ালসড়ক ভাঙা শুরু হয়ে গেছে।
এখন আমাদের আশা-ভরসার জায়গা মেট্রোরেল। উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটটি চালু হওয়ার কথা বছর দুয়েকের মধ্যে। আর ২০৩৫ সালের মধ্যে আরও চার রুটে মেট্রোরেল তৈরির পরিকল্পনা আছে, সে অনুযায়ী কাজও চলছে। ১৩ বছর পর পাঁচটি রুটে যখন মেট্রোরেল চালু হবে, তখন ঢাকার পরিস্থিতি কি কিছুটা সহনীয় হবে? ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার খরচ করার পর এ মেট্রোরেল পরিবহনব্যবস্থার মাত্র ১৭ ভাগ চাপ নিতে পারবে!
উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নয়নকাজ আমাদের কাছে দৃশ্যমানও হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ঢাকা শহরে এ পর্যন্ত যে উন্নয়ন হয়েছে, তা জনগণকে স্বস্তি দেয়নি। সামনে যেগুলোর কাজ হচ্ছে, সেগুলো শেষ হলে ঢাকাবাসী আরাম পাবে, সেই আশা করা যাচ্ছে না। এমন এক দুর্ভাগ্যের মধ্যে আমরা পড়লাম কেন? এর জন্য ‘খেয়ালখুশিমতো উন্নয়ন’কে দায়ী করেছেন যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. সামছুল হক।
‘খেয়ালখুশিমতো’ উন্নয়ন কি আমাদের জ্ঞানবুদ্ধির অভাবে হচ্ছে নাকি এর পেছনে কারণ আছে? বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু বাস রুট ঠিক করে এক বা একাধিক কোম্পানিভিত্তিক গণপরিবহনব্যবস্থা কার্যকর করতে কারও কোনো আগ্রহ নেই কেন? আমরা দেখছি, ১৭ ভাগ যাত্রী পরিবহন করবে যে ব্যবস্থা, সেখানে হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ হচ্ছে অথচ ৪০ ভাগ যাত্রী পরিবহনের চাপ নিচ্ছে যে পরিবহনব্যবস্থা, তার উন্নয়ন থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। সবচেয়ে বড় কথা বাসভিত্তিক গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে তেমন অর্থকড়ির ব্যাপার নেই আর এতে সময়ও বেশি লাগার কথা নয়। বোঝা যাচ্ছে, সমস্যাটা আমাদের জানাবোঝার অভাব নয়। আসল কথা হচ্ছে, যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার সুযোগ নেই, তা নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের আগ্রহ নেই। কেন নেই, তা বুঝিয়ে বলার দরকার আছে কি?
আমরা যাকে ‘উন্নয়ন’ বলছি, তার লক্ষ্য কী, সেটাই আসল কথা। লক্ষ্য যদি ভিন্ন হয়, তবে ‘উন্নয়ন’ চলতেই থাকবে আর আমরা রাস্তায় আটকে হয় ‘টেনশন’, না হয় ‘হেঁচকি তুলে’ কাঁদতে থাকব।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক