শিশুরা অনলাইনে ক্লাস করছে। কেউ স্বেচ্ছায়। অনলাইন ক্লাস শুনলেই কারও মুখ চিরতা খাওয়া মুখের মতো হয়ে যাচ্ছে। তারা হয়তো ক্লাসে বসছে, কিন্তু শিক্ষকদের নির্দেশনামতো সবকিছু খাতায় তুলছে না। বাবা-মায়েরা সন্তানের পড়াশোনা তদারকি করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। বিশেষ করে যাঁরা কর্মজীবী অভিভাবক। রাজধানীসহ শহরের শিশুরা খেলার জায়গা পাচ্ছে কম। আমরা সারাক্ষণ বলছি শিশুকে প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে। তার স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিতে। কিন্তু স্ক্রিন টাইম কমানোর জন্য বিকল্প যা যা দরকার, তা কী আমরা তাকে দিতে পারছি?
ঘরবন্দী এই সময় ছাড়াও আমাদের সন্তানদের শৈশব যে আগেও খুব প্রাণবন্ত ছিল, তা কিন্তু নয়। শিশুরা সব সময়ই কমবেশি চার দেয়ালে বন্দী ছিল। মুক্ত বাতাসে, সবুজ ঘাসে ঘুরে বেড়ানো-খেলাধুলা, কিন্তু তারা আগেও খুব একটা করতে পারত না। একদিন হয়তো আমরা করোনামুক্ত হব। তখনো কী আমাদের সন্তানেরা নিরাপত্তার নামে এমন চার দেয়ালে বন্দী থাকবে?
আমি আমার সাত বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে নিয়মিত রেস্তোরাঁয় যাই শুধু প্লে জোনের জন্য। এতে খাওয়াদাওয়া ছাড়াও অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে পারে সে। প্লে জোনে দিশেহারা হয়ে শৈশব উদ্যাপন করে আমাদের সন্তানেরা। যে সময়টাতে সবুজ মাঠে দাপিয়ে বেড়িয়েছি আমরা, সেই সময়টাতে খেলার মাঠের বদলে রেস্টুরেন্টের প্লে জোনই আমাদের শিশুদের ভরসা।
‘প্লেটো’র মতে, শৈশবকালীন খেলা হচ্ছে পরবর্তী জীবনের জ্ঞানের ভিত্তি। খেলার প্রধান উদ্দেশ্য আনন্দ লাভ। কিন্তু শিশুর বিকাশের জন্য খেলা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাটনি স্মিথ বলেছেন, অনুকরণ, অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গঠন—এই চারটি মূল প্রক্রিয়ায় আমরা পৃথিবী সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি, শিশুর খেলা সেই চারটি প্রক্রিয়া নিয়েই গঠিত। শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মানসিক, সামাজিক, আবেগ বিকাশেও খেলাধুলার গুরুত্ব অনেক। খেলার মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, সামাজিক জ্ঞানবোধ, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব এবং নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয়।
নগরের আয়তনের কমপক্ষে ২০ থেকে ২৪ শতাংশ খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু রাজধানীতে আমরা দেখছি তা আছে মাত্র ৪ শতাংশ। এর কারণ হচ্ছে, আমরা পরিকল্পিতভাবে এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছি। আমাদের রাজধানীতে আরেকটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা রমনা পার্ক তৈরি হয়নি। ব্রিটিশ আমলের ফ্যাসিলিটি নিয়েই চলছি। সন্তানদের জন্য সবুজের চিন্তার চেয়ে ইট-কাঠের চার দেয়াল নিয়ে তৎপর আমরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুর জন্য দিনে অন্তত এক ঘণ্টা বাইরে খেলাধুলা করার পরামর্শ দিচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকটি সন্তান কি সেই সুযোগ পাচ্ছে? ঢাকা শহরের মাত্র ২ শতাংশ শিশু খেলার মাঠে গিয়ে খেলার সুযোগ পায়। ২০ শতাংশ কিশোর এবং ২৯ শতাংশ কিশোরীর মধ্যে হতাশার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। শিশুরা খেলার সুযোগ পাচ্ছে না, বিশেষ করে মেয়েশিশুরা আরও বেশি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশু-কিশোরেরা মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। হতাশা, বিষণ্নতা, অবসাদ ও খিটখিটে মেজাজ তাদের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অসহিষ্ণু মনোভাব। পারস্পরিক সমঝোতা ও সহানুভূতিশীল আচরণ সাংঘাতিকভাবে কমে যাচ্ছে। বাড়ছে আক্রোশ ও স্বার্থপরতা।
এগুলো শিশুর অপূর্ণ মানসিক বিকাশের বহিঃপ্রকাশ। এই অপূর্ণ মানসিক বিকাশের ফল ইতিমধ্যে আমরা ভোগ করতে শুরু করেছি। কিশোরদের ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আমরা চারপাশেই দেখতে পাচ্ছি। মানসিক সুস্থ বিকাশের অভাবে তরুণেরা জড়িয়ে পড়ছেন জঙ্গিবাদসহ নানা সহিংস কর্মকাণ্ডে। বড় অসহিষ্ণু আমাদের কিশোর-তরুণেরা। এ ধারা থেকে উত্তরণের পথ না বের হলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। সময় হয়েছে এখনই ভাবার। করোনামুক্ত পৃথিবীতে আমাদের সন্তানদের দুধ-ভাতের নিশ্চয়তার সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে মুক্ত বাতাসে খেলার নিশ্চয়তাও।
জোহরা শিউলী উন্নয়নকর্মী