পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যখন অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়, ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার একটি অফিশিয়াল ঘোষণা গোপনে বেতারযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছে যায়। অখণ্ড পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকার গঠনের বৈধ প্রতিনিধির এটিই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা। তারই ভিত্তিতে ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস এবং এ বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
তবে ষাটের দশক থেকে বাঙালির মনের অসন্তোষ ও আকাঙ্ক্ষার যে স্ফুরণ শুরু হয়েছিল তার অভিজ্ঞতা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা জানেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাঙালিদের এই অবস্থান আকস্মিক নয়। ধাপে ধাপেই বাঙালি এই পর্যায়ে এসেছে। আর একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকেই ঢাকা ও সমগ্র প্রদেশে যা ঘটছিল, তাতে একটি জাতির স্বাধীনতার স্পৃহা একটুও ঢাকা ছিল না। সচেতন সবারই জানা ছিল স্বাধীনতা কেবল সময়ের ব্যাপার বা বিষয়টা স্বাধীনতাই নয়, স্বাধীনতা কখন কীভাবে আসবে, সেটিই ছিল সেদিনের প্রশ্ন।
তখন যেসব অর্থনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাংকের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁদের অন্যতম রেহমান সোবহান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার তারিখ হওয়া উচিত ৫ মার্চ ১৯৭১, সেদিন থেকে বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ন্যস্ত ছিল।’ (প্রথম আলো, ৫ মার্চ ২০২১) মাওলানা ভাসানী, এমনকি অলি আহাদ, যাঁরা তখন অন্য দল করেন, মতাদর্শিক দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই ছিলেন, তাঁরাও মার্চে বলছেন, এ প্রদেশে সরকার পরিচালিত হচ্ছে মুজিবের হাতে, এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়াই হলো কাজ। মার্চের ২৫ তারিখ পর্যন্ত অসহযোগ ও সরকারের কাজ দুটোই চলেছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, ঘরে ঘরে উড়ছিল কালো পতাকা, পরে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা, যানবাহনেও ছিল এ দুই পতাকা।
এ রকম প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের ভাষণ ও অন্তিম ঘোষণায় স্বাধীনতা ও মুক্তির যে বারতা ছিল, তাতেই উন্মুখ–ব্যাকুল জনতা পথনির্দেশ পেয়ে গেছে। এরপর কেবল বাঁধভাঙার কাজ। তা ভেঙেছে রাজপথে গণজোয়ারে ভেসে গেছে পাকিস্তানের সব প্রতিরোধ, সব নিশানা, তাদের সেনাবাহিনী বন্দী ছিল সেনানিবাসে। বাঙালি পুলিশ, আনসার, আমলা, শিল্পী-সাহিত্যিক, পেশাজীবী, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, সাধারণ চাকুরে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সবাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন, দল বেঁধে স্বাধীনতার জন্য কাজ করার শপথ নিয়েছেন। ছাত্র-শ্রমিক ও তরুণসমাজ তো এক দিনের জন্যও রাজপথ ছাড়েনি। তখন জনপ্রিয় বহুশ্রুত স্লোগান ‘ছিল বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
একটি সুতা বা দণ্ডকে ঘিরে যেমন মিছরি দানা বাঁধে, তেমনি একজন মানুষকে ঘিরেই স্বাধীনতার জন্য উদ্বেল বাঙালি জোটবদ্ধ হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক নেতার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশী সমাজ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমাজে প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব।’ আর তাঁর শেষ জন্মদিনের বিখ্যাত ভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’–এ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর হতাশা ও সংশয়ের মধ্যেও কবি অন্তিম আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে নৈরাশ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মম আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে।’ তাঁর এ ভাষণের ও তাঁর মৃত্যুর তিন দশক পরে সত্যিই অভীষ্ট সেই জননায়কের আবির্ভাব ঘটেছিল এই বদ্বীপ-বাংলায়, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাস এই ¯স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির জন্মের এই মাহেন্দ্রক্ষণকে যেন এক মোহনায় পৌঁছে দিল ২০২০-২১ সালে শতবর্ষ ও অর্ধশতবর্ষের তাৎপর্যময় উপলক্ষের সূত্রে।
২.
বাঙালির মুক্তির সাধনা কি আজকের? ব্রিটিশ-ভারতের সংগ্রামের কথা আজ থাক, আজ কেবল পাকিস্তানের পরিসরে তার স্বাধীনতার উদ্যোগগুলোর কথা স্মরণ করা যায়।
পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই তো রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের অবাঙালি নেতৃত্বের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাঙালির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ সময় থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজ সমাজের নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। দশকজুড়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনার অভিজ্ঞতায় সেই চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে, বিকশিত হয়েছে। ষাটের দশকের একেবারে গোড়াতেই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনে ছাত্রলীগের কয়েকজন মিলে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। নির্দেশনা ছিল মহকুমা ও থানা পর্যায়ে এর নিউক্লিয়াস গঠনের। শিল্পী-সাহিত্যিকেরাও বসে ছিলেন না। ১৯৬২ সালের এ রকম একটি উদ্যোগ অপূর্ব সংসদ প্রতিষ্ঠা। এর পুরো নাম ‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’। এ সংস্থার অনেকগুলো বৈঠক হয়েছিল কবি সুফিয়া কামালের বাসায়। আর এই অস্থায়ী সরকারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল, প্রধানমন্ত্রী আবদুল আজিজ বাগমার। এঁদের ইশতেহার ও অনেক তাত্ত্বিক লেখাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ড. আহমদ শরীফের। এর সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন বাংলা বিভাগেরই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আবদুল হাইসহ অনেকেই।
আজ এ কথা বলা যায় যে ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সবটাই পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কল্পনার কাজ নয়। তারা হয়তো প্রধান আসামি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে টার্গেট করে মামলা সাজাতে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছিল। তাতে বিক্ষুব্ধ বাঙালির ক্ষোভের বারুদে দেশলাই কাঠির ছোঁয়া লেগেছিল। এখন জানা যায় সামরিক বাহিনীর স্বাধীনতাকামী কয়েকজন অফিসার ষাটের দশকের গোড়া থেকেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। আর এ উদ্যোগটি সম্পর্কেও বঙ্গবন্ধু অবগত ছিলেন। ছোট ছোট ঝরনা, নির্ঝরিণী, খাল, নদী, যেমন মহানদীতে মিশে সমুদ্রের দিকে ছোটে; তেমনি বাঙালির বহু ধরনের ছোট–বড় নানা প্রয়াস এসে উনসত্তরে মিশেছিল বঙ্গবন্ধু নামক এক মহানদে। তার সম্মিলিত খরস্রোতা প্রবাহের কাছে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সব বাঁধ ভেঙে যায়, খড়কুটোর মতো ভেসে যায়।
৩.
বাঙালি কেন স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিল? শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের অবসান চেয়েছিল তারা। একদিন ভরসা রেখেছিল পাকিস্তানের ওপর, তারা গভীর আস্থায় নেতারূপে গ্রহণ করেছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে। পাকিস্তান তার ভরসার জায়গা হতে পারেনি, জিন্নাহ তার আস্থার প্রতিদান দেননি। পাকিস্তানে সে প্রতারিত-রিক্ত, বঞ্চিত-শোষিত হয়েছে। দুই দশক চলে গেল আস্থায় নেওয়ার মতো একজন নেতা পেতে, জাতীয় ঐক্য গঠন করতেও সময় লাগল। এবার তার অভীষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ, নেতা বঙ্গবন্ধু। এ জোয়ার ১৯৪৬-এর গণভোটের মতো আকস্মিক পাহাড়ি ঢলের বান নয়, সময় নিয়ে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতার পুঁজি নিয়ে, বহু মানুষের ছোট–বড় নানা উদ্যোগের সঞ্চয় আর সবাইকে ছাপিয়ে ওঠা এক বলিষ্ঠ বাঙালির নিরাপদ নেতৃত্ব এবার তার ভরসা। এবার কেবল ভোট দিয়েই কাজ হয়নি। মানসিক প্রস্তুতিও রইল অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার, সর্বস্ব বাজি রেখে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার।
মানুষ হার মানেনি, জাতির ত্যাগের বহরও অনেক বড়। এমন ঘটনা বাংলায় আগে ঘটেনি। লাখ লাখ বাঙালির রক্তে এ মাটি ভিজেছে, লাখো মায়ের কোল খালি হয়েছে, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, সহায়সম্পদ পুড়েছে, সেতু-কালভার্ট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। হত্যা-মৃত্যু, প্রতিশোধ-আত্মত্যাগ, জিঘাংসা-প্রেম, ক্রোধ-প্রীতি, ধর্ষণ-বরণ মানুষের আদি মৌলিক নানা ইন্দ্রিয়ের প্রকাশ ঘটে রণাঙ্গনে। এই অভিজ্ঞতার বড় অংশজুড়ে থাকে ধ্বংসের চিহ্ন, যদিও অন্তরে বিজয়ের ডঙ্কাও বাজে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বিজয়ের পর মস্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এই সব তীব্র ব্যক্তিগত অনুভূতিকে ছাপিয়ে স্বাধীনতা ও তার সুফল বাস্তবায়নের মতো মস্ত দায় পালন। এ সহজ কাজ নয়, এ যেন ধ্বংসের ছাই থেকে কিংবদন্তির ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ। সেই কঠিন কাজ কঠিনতর হলো সাড়ে তিন বছরের মাথায় ভরসার স্থল নেতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে। প্রায় চার দশক ধরে বিভ্রান্ত জাতির পথে-বিপথের ঘুরপাকে দিকহারা কেটে গেল। তারপর গুছিয়ে তার যাত্রা শুরু হলো, উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, আর সাফল্যের ফসলও নানা সূচকে ধরা পড়ছে, নানান স্থাপনায় দৃশ্যমান হচ্ছে, মানুষের জীবনচর্যায় ফুটে উঠছে। এবার নেতৃত্বের ব্যাটন রয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে। এক দশক বা এক যুগ সময়ের বিচারে বড় কিছু নয়, তাই বলতে হবে পথ এখনো দীর্ঘ, উন্নত দেশ হয়ে উঠতে এখনো অনেক কাজ বাকি।
বঙ্গবন্ধু এবং এ জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও বাতাবরণের বিকাশ, ধর্ম–বর্ণ-লিঙ্গ ব্যবধান ঘুচিয়ে উদার মানবিক সমাজ বিনির্মাণ। সেসব কাজের কিছু হয়েছে, অনেক রয়েছে বাকি। তবে ভিত পড়েছে, সৌধ নির্মাণের কাজ চলছে, এবার তার অবয়ব ও চেহারা ফুটিয়ে সমাজব্যাপী প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে দেওয়াই কাজ। আশার কথা, স্বপ্নের রূপায়ণ বাস্তব হয়ে উঠেছে, প্রাণেরও সাড়া মিলছে। এখন কাজ হলো জাতির ঐক্য সাধন এবং সেই ৭ মার্চের মতো ঐক্যবদ্ধ জাতিকে কাজের ময়দানে নেমে পড়ার উদ্দীপক ডাকটি দেওয়া। তারই অপেক্ষা এখন।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক