‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’ (বারোজন ক্ষিপ্ত পুরুষ) হলিউডে তৈরি একটি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র। ১৯৫৭ সালে নির্মিত ছবিটি ১৯৫৮ সালে অস্কার পায়। ছবির মূল উপজীব্য একটি খুনের রায়। খুনি এক তরুণ। তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। অপরাধ, সে পিতৃহন্তা। অকাট্য তথ্যপ্রমাণে মিলল তরুণটিই খুনি। এবার আমজনতার মধ্য থেকে দৈবচয়নের মাধ্যমে বারোজন জুরিকে ডেকে আনা হলো চূড়ান্ত রায় কার্যকর করার আগে আবার সব তথ্যপ্রমাণ ভালোমতো বিশ্লেষণ করে তাদের চূড়ান্ত মত দেওয়ার জন্য। উল্লেখ্য, উন্নত দেশে সুনাগরিকত্বের অন্যতম শর্ত হচ্ছে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষকে জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও জনপ্রতিনিধি জুরি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। চলচ্চিত্রের আমজনতার বারোজন কেউ কাউকে জানেন না, চেনেন না। বারোজনের এগারোজনেরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তরুণটিই খুনি। তথ্যে কোনো দুর্বলতাই নেই। শুধু একজন জুরির বক্তব্য, গরমিল আছে কি নেই বিষয় নয়, তিনি শতভাগ নিশ্চিত যেহেতু নন, পর্যালোচনা চলতেই হবে। শেষমেশ গভীর বাহাস-বিতর্ক-রাগ-ক্ষোভ-উষ্মা ও ভাবনার দ্বান্দ্বিকতা পেরিয়ে সবাই নিশ্চিত হলো আসলে এ খুন ছেলেটির করা নয়।
বাংলা সাবটাইটেল-সংবলিত এ সিনেমা বাংলাদেশের সব মানুষকে দেখানো দরকার। তাতে জনপরিসরে আলোড়ন তোলা খুন, রায় ও বিচারব্যবস্থা বিষয়ে না বুঝে, না শুনে ঝাঁপ দেওয়া কমবে নিশ্চিত।
বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা ও বীভৎসতা হৃদয়হীন খুনিদেরও স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জনগণের দাবি ছিল এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে রাজনৈতিক দয়ামায়ার ছিটেফোঁটাও ছাপ না থাকুক। আরেকটি দৃষ্টান্ত থাকুক। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এ রকম অপকর্ম চলতেই থাকবে—এ ভাবনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সমর্থন পেয়েছিল। যেকোনো হত্যাকাণ্ডে মানুষের আবেগের প্রকাশটিই সবচেয়ে আগে হয়। তারপর আস্তে আস্তে একসময় জনগণ ভাবার ও বিশ্লেষণের সুযোগ পায়। কারণ তত দিনে পূর্বাপর ঘটনাপরম্পরা ও যাচাই-বাছাই করা তথ্য তাদের হাতে আসে। সংগত কারণেই মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল খুনিদের ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি যেন না হয়। তারপর একসময় এই একই ভাবনার মানুষই হয়তো ভাবতে শুরু করেছিল, ফাঁসি হোক, জেল হোক, ন্যায়বিচারটি যেন হয়। আবরারের পরিবার যেন মনে এই সন্তোষ ধারণ করে ঘরে ফিরতে পারে যে তারা সুবিচার পেয়েছে। কুড়িজন মানুষের শাস্তির খবরে তাই তারা হয়তো সবচেয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। আবেগের জায়গা থেকে সেটিই হওয়ার কথা। তবে এ রায় আমজনতার মধ্যে নতুন ভাবনার জন্ম দিক।
আবরার হত্যার রায় এমন এক জটিল সময় হয়েছে, যখন একজন প্রতিমন্ত্রীর কুকীর্তি প্রকাশ হতে শুরু করে শাস্তি পাওয়ার ঋতু চলছে। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিকে সচেতন মানুষ ভয় করে। আমরাও ভয় পাচ্ছি। আমজনতার এক বড় অংশ না বুঝেই এই রায় নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশসহ আলাপ-আলোচনায় মত্ত হয়ে থাকবে। আড়ালে চলে যাবে প্রতিমন্ত্রীর অপকর্মের ইতিহাস বা অন্যদের কেঁচো-সাপ ইত্যাদি বেরিয়ে আসার আশঙ্কা।
প্রথম কথা, রায় হয়েছে, কার্যকর হয়নি। এখনো নানা প্রক্রিয়া বাকি। অনেকে হয়তো ক্ষমা পাবেন। কারও শাস্তি লঘু হতে পারে। এ কারণে এখনই বিশেষ আলাপচারিতা অপ্রয়োজন। তবে লক্ষণীয়, রায়টি এমন এক জটিল সময় হয়েছে, যখন একজন প্রতিমন্ত্রীর কুকীর্তি প্রকাশ হতে শুরু করে শাস্তি পাওয়ার ঋতু চলছে। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিকে সচেতন মানুষ ভয় করে। আমরাও ভয় পাচ্ছি। আমজনতার এক বড় অংশ না বুঝেই এই রায় নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশসহ আলাপ-আলোচনায় মত্ত হয়ে থাকবে। আড়ালে চলে যাবে প্রতিমন্ত্রীর অপকর্মের ইতিহাস বা অন্যদের কেঁচো-সাপ ইত্যাদি বেরিয়ে আসার আশঙ্কা। তাতে হয়তো দ্রুতই শাসক দল রাজনীতির ক্ষতিটুকু পূরণ করে নিতে পারবে। শাসকশ্রেণির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে এক দল। সামাজিক মাধ্যম উপচে পড়বে ধন্যবাদে। ‘খুনি যে-ই হোক, যে রাজনীতিরই হোক, তার ছাড় নেই’ বাদ্যকথার খইও হয়তো ফুটবে। কিন্তু সুবিচার হয়েছে ভাবতে হলে খানিকটা অতীত টানা ছাড়া উপায় কী? সাগর-রুনি হত্যার বিচার কি হয়েছে? বিশ্বজিৎ হত্যায় আসলেই কি সুবিচার মিলেছে? চাইলে আরও অজস্র অসংখ্য উদাহরণই টানা যাবে।
মৃত্যুদণ্ড উল্লাসের বিষয় কিন্তু নয়। আবরারকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আরও কুড়িজনের প্রাণ যাওয়া যদি খুনখারাবি থেকে খুনিদের ‘নিরস্ত’ করা বা ‘দৃষ্টান্ত’ তৈরি করার জন্য হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হবে বিষয়টির জন্য গভীর পুনর্ভাবনার দরকার। কারণ, মৃত্যুদণ্ডকে একধরনের বিচারিক হত্যাকাণ্ড বলা হয়ে থাকে। এ কারণে বিশ্বের ১৪৪টি দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে। ১০৮টি দেশে সব অপরাধের ক্ষেত্রেই, এক হাজারটি খুন করলেও মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত। মাত্র ৫৪টি দেশে মৃত্যুদণ্ড টিকে থাকলেও সেগুলোর প্রায় অর্ধেক দেশেই প্রয়োগ সীমিত। প্রয়োজনে অপরাধ বিচারে ২০০ থেকে ২৫০ বছরের হাজতবাসের রায়ের উদাহরণ আছে। বিষয়টি রূপকার্থক। অত বছর কেউই বাঁচে না। কিন্তু ‘দৃষ্টান্তমূলক’ বা ‘নিরস্তমূলক’ ধরলে এসব উদাহরণকেই ধরা যায়।
একবার প্রাণ নিলে তাকে আর জীবন্ত করার সুযোগ নেই। সারা বিশ্বেই অনেক উদাহরণ আছে যে ভুল বিচারে ১২ থেকে ১৪ বছর সাজা খাটার পর প্রমাণ মিলল লোকটি অন্যের অপরাধে সাজা খেটেছেন। মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এখন এসব মৃত ব্যক্তিকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? নৈতিক বিচারে সেগুলো স্পষ্টই হত্যাকাণ্ড। দুই. মৃত্যুদণ্ড ‘রেট্রিবিউটিভ’ বা প্রতিশোধমূলক বা ব্যবস্থা। ‘চোখের বদলে চোখ’ পদ্ধতি অমানবিকই নয়, নৃশংসও বটে। গান্ধী যেমনটি বলেছিলেন, চোখের বদলে চোখ দুনিয়াকে অন্ধ করে ফেলবে। তিন. মৃত্যুদণ্ডব্যবস্থা বিদ্যমান দেশগুলোয় খুনোখুনি এখনো অনেক বেশি। এমন অসংখ্য খুনের ঘটনা ঘটে, যেখানে একটি খুনকে আড়াল করার জন্য উপর্যুপরি খুন চলতেই থাকে। আমরা একে সিরিয়াল কিলিং নামে চিনি। চার. বাঁচার সুযোগ দিলে অপরাধীর অনুতাপ, পরিতাপ ও অনুশোচনার সুযোগ তৈরি হয়। অনেক জ্ঞানীগুণীর জন্ম হয়েছে জেলখানায়।
জেলখানা থেকে সৃষ্টিশীল মানুষের সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ লেখালেখি পৃথিবীময় জ্ঞানজগৎকে উন্নত করার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা কাজ বহু ভলিউমের ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি’ সৃষ্টির প্রাক্কালে যিনি ১০ হাজার ধারণার সবিস্তৃত সংজ্ঞা পাঠিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন একজন খুনি। এ বিষয়ে সাইমন উইনচেস্টার লিখেছেন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য প্রফেসর অ্যান্ড দ্য ম্যাডম্যান’। এ নামে একটি চলচ্চিত্রও হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের যথেচ্ছ ব্যবহার ‘প্রিসিডেন্স’ বা উদাহরণ তৈরি করে। সে কারণে এটি বেশি বিপজ্জনক। ক্ষমতার পালাবদল হয়। একদল ক্ষমতা হারালে প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় আসে। তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য প্রয়োজন হয় ‘আগের উদাহরণ’-এর। আগের দু-একটি উদাহরণ থাকলে তারা সহজেই রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের সিদ্ধতা ও বৈধতা দিয়ে দিতে পারে। বলতে পারে, ‘কেন, আমাদের আগে তো অন্যরাও করেছে’। স্বৈরশাসকেরা মৃত্যুদণ্ডকে অপরাধ দমনের বদলে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ জাতীয়করণের কাজে বেশি ব্যবহার করেন। ইরাক, ইরান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মৃত্যুদণ্ডের অন্যায় ও অন্যায্য অপব্যবহারের উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড বিলোপ বা সীমিতকরণের ভাবনাটি শুরু হোক।
হেলাল মহিউদ্দিন অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ