গাফ্ফার ভাইয়ের একটা লেখা আসলেই আমার নামে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের সেই ঘটনার জন্য আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কেমন করে ঘটল, তা-ই প্রথমে বলা দরকার।
এই লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম গত গ্রীষ্মে। যেদিন বিবিসির সাবেক সহকর্মী কামাল আহমেদের কাছ থেকে গাফ্ফার ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার খবর পাই। সেদিনই কেমব্রিজে বিলেতে বসবাসকারী পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর এক অনুষ্ঠানে গাফ্ফার ভাইকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। কাকতালীয়ভাবে একই মঞ্চ থেকে আমার নামও ঘোষণা করা হয়েছিল। কামাল আহমেদ গাফ্ফার ভাইয়ের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
গাফ্ফার ভাই এবং এরশাদ মজুমদার আমার সাংবাদিকতা জীবনের দুই প্রধান চরিত্র। স্বাধীনতার পর জেল হত্যাকাণ্ডে নিহত চার নেতার একজন, এ এইচ এম কামারুজ্জামানের পৃষ্ঠপোষকতায় গাফ্ফার ভাইয়ের সম্পাদনায় দৈনিক জনপদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই কাগজেই বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে আমার শিক্ষানবিশি শুরু হয়েছিল। এরশাদ মজুমদার ছিলেন কাগজটির প্রধান প্রতিবেদক, আমি যাঁর অধীনস্থ ছিলাম।
১৯৭২ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি জনপদে যোগ দিয়েছিলাম। তার কয়েক দিন পর গাফ্ফার ভাইকে প্রথম দেখি। তিনি অফিসে এসে সংবাদকক্ষে বসে সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন বার্তা সম্পাদক কামাল (লোহানী) ভাই, এরশাদ ভাই, আমাদের ইউনিয়ন নেতা সৈয়দ জাফর, চিফ সাব (পরবর্তীকালে জনকণ্ঠ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক) বোরহান (আহমেদ) ভাই। আমাকে অফিসে দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, এ কে? কামাল ভাই জানান, ‘ওর নাম জাওয়াদ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার।’ আমার গায়ে, চেহারায় তখনো মফস্বলের মধ্যবিত্ত ছাপ স্পষ্ট। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোত্থেকে আসছ?’
জানতাম তিনি বরিশালের উলানিয়ার বিখ্যাত পরিবারের ছেলে। তাই কিছুটা নৈকট্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় বললাম, বরিশাল থেকে।
বরিশালে কোথায় তোমার বাড়ি?
আমার বাড়ি ফরিদপুরে। জন্ম, বড় হওয়া বরিশালে।
সাংবাদিকতা করবা? না ছাইড়া দিবা?
জি, করব। (একঘর লোকের সামনে তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতে কিছুটা ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম।)
কী পড়?
সাংবাদিকতা।
সেদিন ওই পর্যন্তই।
কলেজজীবনে পূর্বদেশ পত্রিকায় তাঁর লেখা উপসম্পাদকীয় ‘তৃতীয় মত’ নিয়মিত পড়তাম। জীবনের শুরুতেই ডাকসাইটে সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকায় চাকরি ছিল আমার জন্য এক পরম পাওয়া। তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি কথা হওয়ায় হাওয়ায় ভাসছিলাম সেদিন।
গাফ্ফার ভাই জনপদ পত্রিকার জনসন রোডস্থ অফিসে খুব একটা আসতেন না। এলেও দিনের বেলায়। রিপোর্টাররা তখন বাইরে বাইরেই থাকেন। স্ত্রীর অসুস্থতা এবং তখনকার পরিস্থিতিতে তাঁর দেখা কালেভদ্রে পেতাম। অনেকটা যেন পত্রিকার নিবন্ধলেখক হিসেবে প্রতি সপ্তাহে ‘তৃতীয় মত’ লেখাটাই তাঁর দায়িত্ব ছিল। এ কথা সত্য যে জনপদ পত্রিকার বিক্রি খুব বেশি না হলেও তিনি সম্পাদক বলেই পত্রিকাটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো।
তত দিনে এক বছর পার হয়ে যাওয়ায় আমার শিক্ষানবিশি শেষ হয়েছিল। স্টাফ রিপোর্টার হয়ে গেলেও ছাত্র থাকায় দায়িত্ব ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাবিষয়ক খবর সংগ্রহ করা। স্টাফ রিপোর্টার হয়ে যাওয়ায় সকালের রিপোর্টারদের ব্রিফিং মিটিংয়ে হাজির থাকতে হতো। প্রতিদিন সকালে চলে যেতাম অফিসে। সভা শেষে শুরু হতো খবর সংগ্রহের কাজ। বিকেলে ক্লাস শেষ করে আবার অফিসে গিয়ে কাজ শেষ করে ছুটি পেতাম রাত দশটায়। হলে ফিরে খাবার খেতে খেতে প্রায়ই রাত এগারোটা বেজে যেত। খাবার ঘরের কর্মচারী তাজুল আমার খাবার রেখে যেত। অসুস্থ না হলে কারও কক্ষে খাবার পৌঁছে দেওয়ার নিয়ম ছিল না। সাংবাদিক ছাত্র হওয়ায় হাউস টিউটরের বিশেষ অনুমতি পেয়েছিলাম।
সেদিনও যথাসময়ে হাজির হয়েছিলাম। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল বিশেষ ঘটনাটি ঘটে। আগের রাতে খাবার খেয়ে থালা–বাটি ধুয়ে ঘরে ঢুকে দরজা কেবল বন্ধ করেছি, অমনি শুনলাম সেই চিৎকার। ‘কাম আউট কোহিনুর, হ্যান্ডস আপ কোহিনুর, কাম আউট।’ ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভিয়ে দিলাম। আমাদের দুই শয্যার ঘরে তিনজন থাকতাম। বাংলা বিভাগের আতিকের সঙ্গে থাকত ওরই সহপাঠী জামালপুরের গনি। ওরা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে তখন। ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে আছি।
ঘণ্টাখানেক পর জনপদ টেলিগ্রাম বের হলো। প্রথম পাতায় নামফলকের নিচেই বড় একটা ছবির পাশে এক কলামের খবর। শিরোনাম, ‘কাম আউট কোহিনুর, হ্যান্ডস আপ।’ মূল খবরে আমার লেখা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে আজ সাতজন ছাত্রকে কে বা কারা গুলি করে হত্যা করে’ নেই। সেখানে আমার দেখা এবং শোনা ঘটনার বর্ণনা। মনে হয়, কোনো রহস্য উপন্যাস পড়ছি।
সূর্য সেন হলের দালানটা অনেকটা ইংরেজি ‘জেড’ অক্ষরের মতো। এর ভেতরের অংশে দুই শয্যার ঘরগুলো। তারই ছয় তলায় এক কোণের দিকে ৬২৮ নম্বর কক্ষে থাকতাম। কাছেই ৬৩৪ নম্বর কক্ষে থাকত কোহিনুর। ছাত্রলীগের পান্ডা। তার ঘরটা ছিল একটা টর্চার সেল। ছাত্র-লোকজনকে ধরে এনে বেদম মারপিট করা, বান্ধবীদের নিয়ে সময় কাটানো ছিল নিয়মিত। কাছাকাছি ঘরগুলোর সবাই আমরা তাকে এড়িয়ে চলতাম। একবার তখনকার উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর কাছে অভিযোগ করেছিলাম।
ঘটনার কয়েক দিন আগে লিফট দিয়ে নামছিলাম। কোহিনুর তাঁর দলবল নিয়ে ঢুকল লিফটে। আগে লিফটে ঢুকে পড়ায় বের হয়ে যেতে পারছিলাম না। আবার ভেতরেও স্বস্তিতে ছিলাম না। কারণ কয়েক দিন আগেই ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল নিয়ে লিখেছিলাম। সে ছিল শফিউল আলম প্রধানের বিরোধী পক্ষ। আর আমি প্রধানের তখনকার আন্দোলনের কথাই লিখেছিলাম। বিড়ালের কবলে পড়া ইঁদুরের মতো অবস্থা আমার। মনে মনে বলছি, ‘লিফট তাড়াতাড়ি নাম।’ সেই প্রার্থনা পূরণ হওয়ার আগেই কোহিনুর একটা পিস্তল বের করে আমার বুকের দিকে তাক করে বলল, ‘কী সাংবাদিক, দিমু নাকি ফুটাইয়া?’ ওর বন্ধুরা হো হো করে হাসছে। এর মধ্যে লিফট নেমে যাওয়ায় ওরা চলে গেল। প্রধানকে ঘটনাটা জানিয়েছিলাম।
যা হোক, একদল লোক কোহিনুরকে ‘হ্যান্ডস আপ’ করিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে গুলির আওয়াজ পেয়েছিলাম। দুই লিফটে দুদিক থেকে তারা এসেছিল যাতে কোহিনুর পালাতে না পারে। তাকে নিয়ে যাওয়ার পর সেটা একটা নৈমিত্তিক ঘটনা ভেবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে আতিক ঘুম থেকে তুলে কোহিনুর খুন হয় যাওয়ার খবর দিল। অকুস্থল দেখে অফিসে গেলাম সকালের মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার জন্য। গিয়ে দেখি, গাফ্ফার ভাই অফিস এসে গেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, টেলিগ্রাম বের করার।
সিনিয়র রিপোর্টার ওবায়দুল হক কামাল দায়িত্ব পেলেন পুরো খবর সমন্বয়ের। আমি যা দেখেছি, যা শুনেছি, তা বলা সত্ত্বেও আমাকে দায়িত্ব না দেওয়ায় মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলাম। মুখ কালো করে বসে আছি। এ সময় গাফ্ফার ভাই বললেন, ‘তুমি আমার টেবিলে বইসা এতক্ষণ যা বললা, লেইখ্যা ফালাও।’ গাফ্ফার ভাইয়ের টেবিল মানে তাঁর চেয়ারেই বসা। ইতস্তত করে তা–ই করলাম। গাফ্ফার ভাই বসেছিলেন। লেখা হয়ে গেলে এরশাদ ভাইয়ের কাছে তা জমা দিতে গেলাম। ইতিমধ্যে ফটোসাংবাদিক নওয়াব ছবি নিয়ে এসেছে। সংবাদকক্ষে গাফ্ফার ভাই সেগুলো দেখছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘দেখি কী লেখছ?’ আমার লেখা পড়ে বললেন, হয় নাই। তারপর আমাকে নিয়ে ঢুকলেন তাঁর ঘরে। নিজেই লিখতে শুরু করলেন। মাঝেমধ্যে আমাকে টুকিটাকি প্রশ্ন করছেন। আধঘণ্টা পর লেখা হয়ে গেলে সোজা প্রেসে পাঠিয়ে দিলেন। আবারও আমার মন খারাপ। আমার লেখা কপির একটা পাতাও প্রেসে যায়নি।
ঘণ্টাখানেক পর জনপদ টেলিগ্রাম বের হলো। প্রথম পাতায় নামফলকের নিচেই বড় একটা ছবির পাশে এক কলামের খবর। শিরোনাম, ‘কাম আউট কোহিনুর, হ্যান্ডস আপ।’ মূল খবরে আমার লেখা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে আজ সাতজন ছাত্রকে কে বা কারা গুলি করে হত্যা করে’ নেই। সেখানে আমার দেখা এবং শোনা ঘটনার বর্ণনা। মনে হয়, কোনো রহস্য উপন্যাস পড়ছি। কী অবাক, সংবাদপত্রের ভাষায় যাকে বাই লাইন বলা হয়, সেখানে ছাপা রয়েছে আমার নাম। অথচ যা ছাপা হয়েছে, তাঁর একটি অক্ষরও আমার লেখা ছিল না।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছিলেন কাজী জাওয়াদের নামে।
তাঁর চিরশান্তি কামনা করি।
কাজী জাওয়াদ সাংবাদিক। ই–মেইল: [email protected]