আগামী ৩০ বছরে সাব-সাহারান আফ্রিকার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দুই শ কোটিতে পৌঁছাবে এবং এই অঞ্চলের অর্থনীতি শিল্পায়নভিত্তিক হয়ে উঠবে। এ কারণে বিশ্বের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আফ্রিকার উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে এই মহাদেশের প্রতি আরও বেশি আন্তর্জাতিক মনোযোগ দরকার।
বিশ্ব অনেক দিক থেকে যে খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির মধ্য দিয়ে তা সামনে এসেছে। বিশেষ করে মহামারি মোকাবিলায় দেশগুলোর যারপরনাই সমন্বয়হীনতা, দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তা করতে না পারা, দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের আর্থিক বিপর্যয় ঠেকাতে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ না করাসহ স্বাস্থ্যসেবা–সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণে চরম ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বনেতাদের এখন এই দিকগুলোর দিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত বৈষম্য ও বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের গভীর নজর দিতে হবে।
মহামারির প্রভাবে, বিশেষ করে আফ্রিকা এবং অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশগুলোর কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার বিদ্যমান ভঙ্গুর দশা আরও নাজুক অবস্থায় পড়েছে। এই বিষয়কে যদি এখনই স্বীকার করে নিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আসন্ন দশকগুলোতে সারা বিশ্বই খাদ্যঘাটতির মুখে পড়বে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, আফ্রিকাসহ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে ক্রমিক ক্ষুধার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা মহামারির কারণে এ বছরের শেষ নাগাদ দ্বিগুণ হয়ে ২৬ কোটি ৫০ লাখে পৌঁছাবে। এই ধাক্কা সামলে ওঠার জন্য আফ্রিকার কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর বিকল্প নেই। জি-২০ এবং ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) সদস্যদেশগুলো এসব দেশের কৃষি খাতকে জোরদার করতে ভূমিকা রাখতে পারে।
মহামারি মোকাবিলায় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে আর তার জন্য কৃষি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র দেশগুলোতে করোনাকালে লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার কার্যক্রম ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ হলো এসব দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নেই। না খেয়ে মরার হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছে।
দরিদ্র দেশগুলোতে করোনাকালে লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার কার্যক্রম ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ হলো এসব দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নেই। না খেয়ে মরার হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছে
সফল অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্যও কৃষির উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকা ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ যদি শিল্পায়নের দিকে না যায়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি ও অতিদারিদ্র্যহীনতা নিশ্চিত করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়াকে শিল্পায়নভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য আগে কৃষিবিপ্লব ঘটাতে হয়েছিল। ঠিক একইভাবে আফ্রিকাকেও কৃষিবিপ্লব ঘটাতে হবে।
বৈশ্বিক নিরাপত্তা ইস্যুতেও কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। যেসব জায়গায় ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষ বেশি, সেখানেই সন্ত্রাসীদের বাড়বাড়ন্ত হয়ে থাকে। যেমন ক্ষুধাপীড়িত সাহেল (সাব–সাহারান এলাকার খরাপীড়িত একটি ভূখণ্ড) এলাকায় বহু মানুষকে সহজে সন্ত্রাসীরা দলে ভিড়িয়ে আসছে।
আফ্রিকায় ফসল আবাদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থাৎ কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়ন করে নতুন নতুন ধরনের ফসলের আবাদ সেখানে বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আফ্রিকার অনেক নেতাই ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদনে সেনেগাল অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। গম-যবের মতো খাদ্যশস্য আবাদে এগিয়েছে ঘানা। কৃষিব্যবস্থার রূপান্তরে ইথিওপিয়াও অনেক এগিয়ে গেছে।
ঘানা ও আইভরি কোস্ট কোকো উৎপাদন করলেও তা দিয়ে তারা চকলেট উৎপাদন করতে পারে না। তারা যাতে নিজেরাই চকলেট উৎপাদন করতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। নাইজেরিয়াকে তার চাষাবাদ কৃষিযন্ত্রনির্ভর এবং গবাদিপশু পালনকে আধুনিক করতে হবে। মোজাম্বিক ও কেনিয়ায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
এই সপ্তাহেই রুয়ান্ডায় আফ্রিকান গ্রিন রেভল্যুশন ফোরামের সম্মেলন বসছে। এই সম্মেলনে আফ্রিকায় কৃষিবিপ্লব ও সবুজায়নের গুরুত্ব তুলে ধরা হবে। আমি তৃতীয়বারের মতো এই ফোরামের সম্মেলনে থাকছি। আফ্রিকায় কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে আমাদের টিম সেখানে বক্তব্য দেবে। এরপর এ মাসের শেষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে, নভেম্বরে জি–২০ সম্মেলনে এবং আগামী বছর জাতিসংঘের খাদ্যব্যবস্থা সম্মেলনে সেগুলো প্রস্তাব আকারে পেশ করা হবে।
আশা করা যায়, আফ্রিকা কৃষিবিপ্লবে সফল হতে যাচ্ছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● টনি ব্লেয়ার যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জের চেয়ারম্যান