আমেরিকা-পরবর্তী নতুন এক আফগানিস্তানের জন্ম হয়েছে। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের অবস্থানের বদল করছে। কিন্তু প্রযুক্তি ফার্মগুলোর ক্ষেত্রে কী ঘটছে? বৈশ্বিক এই অংশীদার, ক্ষমতার ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক সরকারের সমতুল্য। আফগান সংকটে তাদের অনেক বড় ভূমিকা নেওয়ার আছে। এরই মধ্যে আমেরিকা ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ায় নানা অভিঘাত তৈরি হয়েছে। যেমন হাজার হাজার আফগান দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এ পরিস্থিতি প্রযুক্তি ফার্মগুলোকে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য করছে। বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে তাদের সংঘাতের পরিস্থিতিও সৃষ্টি হচ্ছে।
আফগানিস্তান এখন চালাচ্ছে তালেবান। অনেক দেশ আগে থেকেই তাদের সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়েছে। আফগান সরকারের পরিচালিত ফেসবুক-টুইটার আকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ এখন তালেবানের হাতে। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করেনি। যদিও ফেসবুক তালেবান–সম্পর্কিত কনটেন্টগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আফগান সরকারের অ্যাকাউন্টগুলো থেকে তারা পোস্ট দিতে পারছে।
আফগানিস্তানের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে, সেটা দেখার বিষয়। অনেক রাষ্ট্র যে রকমটা চায়, তার বিপরীতে কোম্পানিগুলো কী অবস্থান নেবে? আবার যেসব আফগান ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাচ্ছে, তারাও ভবিষ্যতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ভারত সরকার আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতে যদি বিপুলসংখ্যক আফগান আশ্রয় পায়, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তালেবানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে। ভারতে অবস্থান নেওয়া আফগানরা তালেবান সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির জন্য অনলাইনে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন।
জাপান থেকে কানাডা, অনেক রাষ্ট্রই তালেবানের বৈধ স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এ ক্ষেত্রে ভিন্ন সুরে কথা বলছে। এটা ভারতের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। চীন, তুরস্ক, রাশিয়ার সঙ্গে আফগানিস্তানে প্রধান শক্তির মধ্যে একটি ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা, বিশেষ করে কাশ্মীরের জন্য নয়াদিল্লি তালেবানের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। কিন্তু ভারতে আশ্রয় নেওয়া আফগানরা যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তালেবানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চেষ্টা করে, তাহলে কি দিল্লির পক্ষে সম্ভব তালেবানের সঙ্গে শক্ত সম্পর্ক স্থাপন করা? ভারত সরকারের উচিত প্রযুক্তি ফার্মগুলোর কাছে যাওয়া। এতে করে তারা একটা কৌশলী অবস্থান নিতে পারে। প্রযুক্তি ফার্মগুলো কি ভারত সরকারের পক্ষ নিয়ে তালেবানবিরোধী কনটেন্টগুলো নামিয়ে দেবে? অথবা তারা কি আফগান শরণার্থীদের পক্ষ নিয়ে তালেবানবিরোধী কনটেন্টগুলো সামনে নিয়ে আসবে? এই প্রথমবার প্রযুক্তি ফার্মগুলো কী অবস্থান নিচ্ছে, তার ওপরে ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্ক প্রভাব ফেলতে পারে।
আফগানিস্তানে এখন যা হচ্ছে, সেটা কেবল মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট নয়। এটা নতুন ধরনের ভূরাজনৈতিক সংকট, যেখানে সরকারগুলোর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে।
মাটির নিচের বিপুল পরিমাণ বিরল খনিজ সম্পদের কারণে আফগানিস্তান এখন অনেকের আগ্রহের জায়গা। সেখানে এক থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের সমতুল্য বিরল খনিজের মজুত আছে। হাই টেক পণ্য তৈরিতে এগুলো ব্যবহৃত হয়। এখন যদি আফগানিস্তানের উন্নয়নের নিয়ন্ত্রণ চীন নেয়, তাহলে খনিগুলোর উন্নয়নের ভার কি চীনা কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাবে না? এ সংকটাপন্ন খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ যদি চীনের হাতে চলে যায়, তাহলে পশ্চিমা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সেগুলো কি অস্ত্র হয়ে উঠবে না?
পরিশেষে, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের কারণে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার ভাবমূর্তি মৌলিকভাবে বদলে গেছে। ইউরোপ থেকে এশিয়া—অনেক জায়গাতেই আমেরিকার প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এর ফলে প্রযুক্তি ফার্মগুলো আমেরিকার ভাবমূর্তি ‘অক্ষুণ্ন’ রাখতে পারছে না। অন্য সরকারগুলো যেমন প্রযুক্তি ফার্মগুলোকে তাদের শাসনের বিরুদ্ধে যাওয়া কনটেন্টগুলো সরিয়ে নিতে বাধ্য করে, ওয়াশিংটনও হয়তো সেটাই করছে। এখানে পরিষ্কার করে বলে রাখা ভালো, সব প্রযুক্তি ফার্ম আমেরিকানদের নয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া অ্যাপ টিকটক কি বিশ্বজুড়ে আমেরিকার ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা কনটেন্টগুলো সরিয়ে দেবে? টুইটারের সমকক্ষ চীনা অ্যাপ ওয়েবুতে এরই মধ্যে ব্যবহারকারীরা বলেছেন, ২০২০ সালে নির্বাচনের পর আমেরিকায় ক্ষমতার পরিবর্তনের চেয়ে আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল ছিল বেশি ‘মসৃণ’। এ ধরনের মন্তব্য ও ধারণা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে, বিশেষ করে জেনারেশন জেডের মনোজগতে প্রভাব ফেলতে পারে।
আফগানিস্তানে এখন যা হচ্ছে, সেটা কেবল মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট নয়। এটা নতুন ধরনের ভূরাজনৈতিক সংকট, যেখানে সরকারগুলোর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে। আফগানিস্তানের সংকট সমাধানের জন্য যদি কেউ উদ্যোগ নেয়, তাহলে সরকারগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তি ফার্মগুলোকেও নেওয়া উচিত। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেটা এখন অনেক বড় প্রশ্ন নয়। সিলিকন ভ্যালি থেকে শেনজেন যেখানটাতেই হোক, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বুঝতে পারছে তাদের হাতে এখন অসাধারণ এক ক্ষমতা। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ভূগোলে সৃষ্ট হওয়া সংকটে নতুন মাত্রা তারা দিতে সক্ষম।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
● অবিশূর প্রকাশ প্রযুক্তি-ভূরাজনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ