বিদায়ী বার্তায় ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি বলেছেন, দেশটির মুসলমান নাগরিকেরা সেখানে নিরাপদ বোধ করে না। তিনি কী বলেছেন, তা খতিয়ে না দেখে বিজেপি ও আরএসএস তাঁর সমালোচনা করেছে। কেউ কেউ এমনকি এ কথাও বলেছেন যে তিনি যেখানে নিরাপদ বোধ করেন, সেখানে চলে যেতে পারেন।
তবে সবচেয়ে পিত্তি জ্বালানো কথা বলেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন, আনসারি এবার নিজের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারেন। উচ্চপদধারী আরও কজন মানুষ এ ধরনের কথা বলেছেন। হিন্দু নেতারা আনসারির কথা খতিয়ে দেখার লেশমাত্র চেষ্টাও করেননি। সে কারণে মুসলমানদের ভীতি দূর করা সম্ভব হয়নি।
এটা ঠিক, ভারতের উপরাষ্ট্রপতি আরও আগেই এ কথা বলে পদত্যাগ করতে পারতেন। কিন্তু তাতে একধরনের সংকট সৃষ্টি হতো এবং সেটা সমাধানে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের গলদঘর্ম হতে হতো। এতে ভারতে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দানা বেঁধে উঠত।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে ভেবে দেখতে হবে, মুসলমান নেতারা কেন নিজ সম্প্রদায়ের কল্যাণ নিয়ে সুযোগ পেলেই প্রশ্ন তুলছেন, বিশেষ করে দায়িত্ব ত্যাগের সময়। আনসারি পছন্দের দেশে চলে যেতে পারেন—এই কথার মাধ্যমে তিনি যে প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, তা আমলে নেওয়া হলো না। আনসারি কিন্তু বলেননি যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপদ নাকি অনিরাপদ। বিদায়ী উপরাষ্ট্রপতি স্রেফ মুসলমানদের ভীতির কথা বলেছেন।
আনসারির ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে লাভ নেই। তিনি কী বলেছেন, সরকারি দলের নেতাদের তা চিন্তা করা উচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠরা কীভাবে এর প্রতিকার করতে পারে, সেই চেষ্টাও তাঁর করা উচিত। আনসারির বার্তা যেভাবে গ্রহণ করা উচিত ছিল, সেভাবে তা করা হয়নি।
আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগওয়াতও এ কথায় সায় দিয়েছেন যে আনসারি যেহেতু ভারতে নিরাপদ বোধ করছেন না, তাই তিনি যেকোনো জায়গায় চলে যেতে পারেন। হিন্দুদের একটি সংগঠনের প্রধান হওয়ায় ভাগওয়াতের কথায় প্রতিনিধিত্বকারীর চরিত্র আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যাপারটা হিন্দু বনাম মুসলমানের অনিঃশেষ বিতর্কের মধ্যে পর্যবসিত হলো।
আনসারির কথা তো সবাই শুনেছে এবং যেহেতু তিনি দেশের উপরাষ্ট্রপতি, সেহেতু সংসদসহ সব দায়িত্বশীল পর্যায়ে এ নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত। ভারতের মুসলমানরা কী ভাবছেন, তা বোঝার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এর আগে কমিশন গঠন করেছে। কমিশনের প্রধান বিচারপতি রাজিন্দর সাচার প্রতিবেদনে বলেছিলেন, দেশটির মুসলমানদের সঙ্গে দলিতদের চেয়েও খারাপ ব্যবহার করা হয়। তিনি দেখিয়েছিলেন, তিন দশক কমিউনিস্ট শাসনের পরও পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের শিক্ষার হার মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। সময় এসেছে আরেকটি কমিশন গঠন করে দেখতে হবে, সাচারের প্রতিবেদনের পর কোনো পার্থক্য ঘটেছে কি না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আগেও মুসলমান নেতারা এমন আক্ষেপ করেছেন। কয়েকজন সেলিব্রিটিও একই কথা বলেছেন। বছর দুয়েক আগে আমির খান ভারতের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে স্ত্রী কিরণ রাওয়ের ভীতির প্রসঙ্গ টেনে একই রকম কথা বলেছিলেন।
তো কিরণের সঙ্গে তাঁর বাসায় কথা বলার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা কি ভারত ছেড়ে চলে যাব?’ কিরণের মুখে এ কথা শোনা অনেক বড় ব্যাপার, বিপর্যয়কর। তিনি সন্তানদের নিয়ে ভীত। পরিবেশ-পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে তিনি ভীত। তিনি দৈনিক পত্রিকা খুলতে ভয় পান। এতে বোঝা যায়, অসন্তোষ ক্রমেই দানা বেঁধে উঠছে। সতর্কতা ছাড়াও একধরনের হতাশা কাজ করছে মানুষের মনে। আমির বলেছিলেন, যখন মানুষ ভাববে এসব কেন ঘটছে, তখন তাদের আত্মবিশ্বাসের পারদ নেমে যাবে। এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমির খান লেখকদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া সমর্থন করে বলেছিলেন, এটা মানুষের অসন্তোষ ও হতাশা প্রকাশের মাধ্যম।
স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি তাঁর কথা পুরোপুরি খারিজ করেছে। বিজেপির মুখপাত্র শাহনওয়াজ হোসেন বলেছেন, আমির খান ‘ভীত নন, কিন্তু তিনি মানুষের মনে ভয় ধরানোর চেষ্টা করছেন। জীবনের সব উপহার ও শ্রদ্ধা তিনি ভারতেই পেয়েছেন। তাঁর এটা ভোলা উচিত নয় যে ভারতই তাঁকে তারকা বানিয়েছে।’ তবে কংগ্রেসের সহসভাপতি আমিরকে নির্ভীক চিত্তে সমর্থন করেছেন। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে মানুষের শান্তি কেন বিঘ্নিত হচ্ছে, সেটা বোঝার জন্য মোদি সরকারের মানুষের কাছে যাওয়া উচিত।
ওদিকে রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন, ‘যাঁরা সরকার ও মোদিকে প্রশ্ন করছেন, তাঁদের দেশপ্রেমহীন, জাতিবিরোধী ও “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” আখ্যা না দিয়ে সরকারের উচিত হবে মানুষের কাছে যাওয়া এবং এটা বোঝা যে কী কারণে তাদের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে।’ কিন্তু বিজেপির মুখপাত্র যথারীতি রাহুল গান্ধীর সমালোচনা করে বলেছেন, জাতিকে কলঙ্কিত করার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
মূল সমস্যা হচ্ছে ধর্মের ভিত্তিতে রেডক্লিফের অঙ্কিত সীমান্ত। দেশভাগের পর হত্যাযজ্ঞের সমালোচনা করেছিলেন তিনি, কিন্তু নিজের ধারা বদলাননি। এর ভিন্ন মেরুতে আছে পাকিস্তানের মানুষেরা, যারা ধীর ধীরে ইসলামি পৃথিবীর মানুষ হয়ে যাচ্ছে। মৌলবাদ জাঁকিয়ে বসছে।
পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখ নেই বললেই চলে। পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যাগুরু হচ্ছে খ্রিষ্টানরা। তাদের অভিযোগ হচ্ছে গির্জা ধ্বংস এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে সেনাবাহিনীর কথাই শেষ কথা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারাও দূষিত হয়ে যাচ্ছে।
আনসারির কথায় সার আছে; কারণ, ভারতে একধরনের নমনীয় হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটছে। জাতির কর্ণধারেরা এই বিভাজন উসকে দিচ্ছেন; কারণ, হিন্দু ও মুসলমানের ভিত্তিতে নির্বাচন হলে হিন্দুরাই লাভবান হবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। গত সাত দশকের চর্চিত ধর্মনিরপেক্ষতা এভাবে মহাবিপদের মুখে পড়বে, তা সত্যিই দুঃখের।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।