সুখের দিনে সত্য না বললেও দুঃখের দিনে সত্য বলে ফেলে লোকে। বাস্তবে দুঃখের মধ্যে দিয়েই সত্যটা জানা হয়। সেই সত্যটা কঠিনই হয়। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনও কঠিন সত্যটা বলে ফেলেছেন। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব বর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগে এত বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী থাকার পরও সংগঠনের অবস্থা কী? নির্দ্বিধায় বলব, যে অবস্থায় সংগঠন থাকার কথা, সেই অবস্থায় নেই।’ নাছির উদ্দীনের এই বয়ান সভায় উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শুনেছেন।
এক যুগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পরও এই অবস্থা কেন? তার উত্তরও নাছির সাহেবের বক্তব্যে রয়েছে। তিনি জানান, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব নেতা-কর্মী সরব, ফেসবুকে তাদের অ্যাকাউন্টগুলো যদি দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে, তারা যে মন্তব্য করে, তারা যে লাইকগুলো দেয়, সবগুলোই আত্মঘাতী। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই শুধু তাদের প্রচারণা। জামায়াত-বিএনপির কোনো নেতার কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনা থাকে না আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের।’
নাছির উদ্দীনের কথায় আক্ষেপের সুর। কিংবা একে বলা যায় আতঙ্কের সাবধানবাণী। তিনি স্পষ্টভাবে বুঝিয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগই। সত্যিই তো, বিরোধীরা যদি না থাকে, তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতা কায়েম করায় বাধা থাকে না। বাধা থাকে না সেই ক্ষমতার বলে ধনসম্পত্তি, টেন্ডার, জায়গাজমি দখল, চাকরি ও সুযোগ-সুবিধা বিক্রির রাজনৈতিক ব্যবসা চালানোয়। সমস্যাটা হয়েছে সেখানেই। দলের ভেতর কেউ বেশি পাচ্ছে আর কেউ কম পাচ্ছে যখন, তখন কম পাওয়ারা বেশি পাওয়াদের বিরুদ্ধে লাগবে। বিরোধী দলের হুমকি যখন থাকে, তখন দলে একধরনের ঐক্য দেখা যায়। সেই হুমকি যখন নেই, তখন ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলই বড় হয়ে দেখা যাওয়ার কথা। এবং সেটাই ঘটছে।
এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া গেল চলমান স্থানীয় সরকার কথা ইউপি নির্বাচনে। যদিও একে নির্বাচন কতটা বলা যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। মাঠ আওয়ামী লীগের জন্য দুরমুশ পিটিয়ে সমান করে রাখা হয়েছে। তারপরও চতুর্থ ধাপে এসে স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা প্রায় অর্ধেক পদ জিতে নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব ছিল সাংগঠনিক ক্ষমতায়। তবে কি তাতেই ঘুণ ধরেছে? ক্ষমতার আরাম আর দুর্নীতির ঘুণপোকা কি তাঁদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে? সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রমাণ হয় গণ-আন্দোলনে। এক যুগ হলো সরকারি ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ এখন আর গণ-আন্দোলনের শক্তি নয়। জনপ্রিয়তার পরীক্ষা হয় নির্বাচনে। যেহেতু নির্বাচনব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে, সেহেতু আওয়ামী লীগ এখন কতটা জনপ্রিয় আর কতটা অজনপ্রিয়, তা প্রমাণেরও উপায় নেই।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চারটি ধাপ শেষ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, ভোটের ফলে আগের থেকে পিছিয়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি এলাকাগুলো, যেমন ফরিদপুরের মতো জায়গায় নৌকার প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানো ২৯ প্রার্থী জামানত হারাতে যাচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ ১০০, এমনকি মাত্র ৯৩টি ভোটের বেশি পাননি। ১৬২টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নৌকার প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ছিলেন না। প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৭৬ শতাংশ পদে জয়ী হলেও চতুর্থ ধাপে তাঁরা জিতেছেন মাত্র ৫১ শতাংশ পদ।
আগে আমরা দেখতাম, সরকারি দল বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয় না। তাদের কর্মীদের মাঠ থেকে তাড়িয়ে দেয়, তাদের ওপর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। ভোটকেন্দ্র দখল হয়, ভোট গণনায় কারচুপি হয় ইত্যাদি। কিন্তু এক যুগের আওয়ামী শাসনে অবস্থা আরও করুণ হয়েছে। বিরোধীরা মাঠ ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোটাররা। নৌকার প্রার্থীর বিপরীতে যেকোনো স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহীকে তাঁরা ভোট দিচ্ছেন।
এবারে যখন বিরোধীরা নেই, তখন ভোটারদের ঠেকাতে হত্যার হুমকি, সন্ত্রাস ও ভোটকেন্দ্র দখলের মহামারি চলেছে। এসবে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা সেঞ্চুরির কাছাকাছি, আহত হাজারো মানুষ। তারপরও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। নিজেদের লোকের কাছেই পরাজিত হচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
ক্ষমতার নিয়ম অ্যামিবার মতো। অ্যামিবা পরিণত হলেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক যুগের ক্ষমতায় পরিপক্ব আওয়ামী লীগ নিজের ভেতরে বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নেতা ও মন্ত্রীরা পর্যন্ত দলীয় লোকের হাতে বেইজ্জত হচ্ছেন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে মার খেয়ে পালিয়ে এসেছেন ঢাকায়। ২৯ ডিসেম্বর সিলেটে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতাদের কাউকে মঞ্চে দেখা যায়নি। কারণ হিসেবে সংবর্ধনার আয়োজক বিএনপিপন্থী মেয়রকে বর্জন করার কথা বলা হলেও, বর্জিত হয়েছেন সিলেটের সন্তান স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয়ও। জেলায় জেলায় এ রকম বিভেদের আলামত এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। বিভাজনটা কোন মাত্রায় গেছে, তার প্রমাণ দিয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন।
আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব ছিল সাংগঠনিক ক্ষমতায়। তবে কি তাতেই ঘুণ ধরেছে? ক্ষমতার আরাম আর দুর্নীতির ঘুণপোকা কি তাঁদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে? সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রমাণ হয় গণ-আন্দোলনে। এক যুগ হলো সরকারি ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ এখন আর গণ-আন্দোলনের শক্তি নয়। জনপ্রিয়তার পরীক্ষা হয় নির্বাচনে। যেহেতু নির্বাচনব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে, সেহেতু আওয়ামী লীগ এখন কতটা জনপ্রিয় আর কতটা অজনপ্রিয়, তা প্রমাণেরও উপায় নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নামে যা হলো, তা তো নিজের উঠানে নাচার দাপট। সেখানেও স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহীরাই যখন কেল্লাফতে করে দিচ্ছে, তখন আর রইল কী? তখন রইল চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের আক্ষেপ, এত বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী থাকার পরও যে অবস্থায় সংগঠন থাকার কথা, সেই অবস্থায় নেই।
বাংলায় একটা কথা আছে: অতি প্রসারিত। ইংরেজিতে বলে এক্সট্রিমলি স্ট্রেচড। ইলাস্টিককে বেশি প্রসারিত করলে শুধু ছিঁড়েই যায় না, ছেঁড়া অংশগুলো যে ধরে আছে তার হাতে এসে আঘাত করে। সব বাতাস এক বেলুনে দিতে হয় না, তাতে বেলুন ফেটে যায়।
সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ যে সংকটে পড়েছে, যে সংকটের প্রমাণ নাছির উদ্দীনের কথায় এবং ইউপি নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, তা ওই বেলুনের সংকট। আওয়ামী লীগের বাতাস হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার বাতাসে সংগঠন গোদাপায়ের মতো ফুলে যায় বটে, সেই পায়ে কিন্তু শক্তি থাকে না। আওয়ামী লীগকেই তাই ভাবতে হবে, তাদের হলোটা কী?
দুই বছর পর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সংগঠন যখন দলীয় কোন্দলে ধারালোভাবে বিভক্ত, তখন কি প্রশাসনই হবে ক্ষমতা ধরে রাখার শেষ ভরসা? ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করা ছাড়া আওয়ামী লীগের হাতে আর কোনো উপায় থাকছে কি?
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]