একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ পৌনে তিন বছর পার না হতেই নতুন নির্বাচনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে আসতেই সরকারি ও বিরোধী শিবির নড়েচড়ে বসেছে। জাতীয় সংসদে যে নতুন করে পুরোনো ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে, তারও লক্ষ্য আগামী নির্বাচন।
কয়েক দিন আগে গণভবনে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতা-কর্মীদের আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। যেসব স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরোধ-সংঘাত আছে, তা দ্রুত তা মিটিয়ে ফেলার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। দলীয় প্রধান একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রীর উদ্দেশে এখনো আওয়ামী লীগার হতে না পারায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তঁার প্রতিদ্বন্দ্বী কনিষ্ঠ নেতাকে জ্যেষ্ঠর প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছেন।
দেশের অধিকাংশ জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নানাভাবে বিভক্ত। বরিশাল শহরে যে ঘটনা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটল, তার মূলেও ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোন্দল। প্রতিমন্ত্রী বনাম মেয়র। মেয়র চান না শহরে আর কারও পোস্টার থাকুক। বিরোধী দলের পোস্টার কোথাও নেই। ফলে তা ছেঁড়ারও প্রশ্ন আসে না। কিন্তু দলের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী নেতার বা প্রতিমন্ত্রীর ছবিযুক্ত পোস্টার লাগানোও মানতে পারেন না বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী মেয়র।
কোথাও মন্ত্রী বনাম সাংসদ, কোথাও সাংসদ বনাম উপজেলা চেয়ারম্যান, কোথাও সাংসদ বনাম স্থানীয় আওয়ামী লীগ। স্থানীয় আওয়ামী লীগ বনাম পৌরসভা মেয়রের মধ্যকার রেষারেষি কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ তথা বসুরহাট। এখানে মেয়র মনে করেন, তিনি যা বলবেন, সেটাই আওয়ামী লীগ নেতাদের মানতে হবে, প্রশাসনকে শুনতে হবে। তাই এ মুহূর্তে বিরোধী দল থেকে আওয়ামী লীগের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকলেও দলের ভেতর থেকে চ্যালেঞ্জ আছে, থাকবে। আগে বিষয়গুলো আড়াল করা গেলেও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না। ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও বৃহস্পতিবার নির্বাহী কমিটির তিন দিনব্যাপী বৈঠক শেষ করেছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা নির্দলীয় সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথে আন্দোলনের পক্ষে মত দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এ রকম একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। জানিয়েছেন, তঁারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবেন না। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়াদা করেও রাখেনি। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই তঁারা নির্বাচনে যাবেন। বিএনপির নেতারা মনে করেন, আগামী দুই বছরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলাবে। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরোধের বিষয়টি তাঁরা পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা বিএনপিকে এড়িয়ে চলতেন, এখন নিজেরাই উৎসাহী হয়ে কথা বলছেন, দেশের পরিস্থিতি জানতে চাইছেন বলেও জানান বিএনপির নীতিনির্ধারকদের একজন।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে জোট রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। দলের অনেক নেতা মনে করেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট করে কিংবা ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করে বিএনপির কোনো লাভ হয়নি। জামায়াতের প্রার্থীরা বেনামে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছেন এবং গণফোরামের দুজন নেতা সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি চেষ্টা করবে সরকারি বলয়ের বাইরের সবাইকে একত্র করতে। সফল না হলে একাই আন্দোলন করবে। বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, করণীয় ও সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেছি। ভবিষ্যতে আরও আলোচনা হবে।’
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি ছোট ছোট দলগুলোও তৎপর হয়ে উঠেছে। জোটের রাজনীতিতে যোগ-বিয়োগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নতুন দল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছাত্র–তরুণদের নিয়েই নতুন দল গঠন করতে চান নুরুল হক ও তঁার সহযোগীরা। অতীতে তাঁরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশের ছাত্র-তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের নেতাদের দাবি, তঁাদের সঙ্গেই দেশের বেশির ভাগ তরুণ আছেন। এ কারণে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে অনেক নেতা-কর্মীকে জেলে রেখেছে। বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণসংহতি ও নাগরিক ঐক্যও নিজ নিজ অবস্থান থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। সবার লক্ষ্য ২০২৩ সালের নির্বাচন।
নির্বাচনী আলোচনার পাশাপাশি আগামী নির্বাচন কমিশনের আলোচনা সামনে এসেছে। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আছে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এরপর নতুন কমিশন আসবে। কীভাবে ও কাদের নিয়ে সেই কমিশন হবে? সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন করার কথা বলা আছে। কিন্তু গত ৫০ বছরে কোনো সরকার তা করেনি। দলীয় সরকার নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কমিশন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন করেছে, তাদের কেউ সফল হয়েছে, কেউ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত রকিব কমিশন ও নুরুল হুদা কমিশনের মতো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এভাবে কেউ ধ্বংস করেনি। দোষটি সার্চ কমিটির নয়। দোষ হলো যঁারা এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন, তঁারা সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়ে ক্ষমতাসীনদের আস্থা অর্জনকে পরম পাওয়া ভেবেছেন।
২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে এক ধারা ছিল, হরতাল–অবরোধ। কিন্তু এরপর গত ছয় বছরে দেশে কোনো হরতাল–অবরোধ, ভাঙচুর, জ্বালাও–পোড়াও কিছুই হয়নি। তারপরও গণতন্ত্রের সূচকে আমাদের এ ক্রমাগত অবনতি কেন, এ প্রশ্নের জবাব কি ক্ষমতাসীনদের জানা আছে?
এই প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচন কেমন ও কীভাবে হবে, আগাম মন্তব্য করা কঠিন। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন গণতন্ত্রের একমাত্র পূর্বশর্ত নয়; প্রধান পূর্বশর্ত। সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেয় না। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের কথা ভাবাও যায় না।
বিবিসি ২০০৮ সালের নির্বাচনে যাঁরা প্রথম ভোট দিয়েছেন, তঁাদের সাক্ষাতের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে সম্প্রতি। সেখানে অধিকাংশ তরুণ বলেছেন, তাঁরা ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আর কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি কিংবা ভোট দিতে যাননি। এই যে নির্বাচন কমিশন তরুণ ভোটারদের ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করল, তার জবাব কী। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যতই ঝগড়া–বিবাদ থাকুক না কেন, ভোটাধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই।
বিবিসির অপর এক প্রতিবেদনে যেসব প্রবণতাকে গণতন্ত্রবিরোধী বা কর্তৃত্ববাদী শাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার প্রথমটি হলো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে নির্বাচনের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়। অতীতে যে বাংলাদেশে নির্বাচনে গড়ে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে, সেই বাংলাদেশে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের খরা চলছে কয়েক বছর ধরে। ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের হার দেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। তাদের এত নেতা-কর্মী, কিন্তু ভোটকেন্দ্রে মানুষ পাওয়া যায়নি।
গণতন্ত্রহীনতার দ্বিতীয় সূচক হলো সংসদ একদলীয় ব্যবস্থায় পরিচালিত হওয়া। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে যে দুটি সংসদ গঠিত হয়েছে, তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীর বাইরে কতজন সাংসদ ছিলেন বা আছেন, তা দেখার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হতে হতে এমন অবস্থায় এসেছে যে দল ও সরকারের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যবধানটিও লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোনটি দলীয় নেতার ভাষণ আর কোনটি সরকারি কর্মকর্তার, তা ফারাক করা কঠিন। এরপর আসে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা ও মতপ্রকাশে (জনগণের) ভয় পাওয়ার বিষয়টি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি ভালো সংবিধান তৈরি করেছিল, যাতে নিবর্তনমূলক আইন ছিল না। রাষ্ট্র চাইলেই যেকোনো নাগরিককে ধরে জেলে পুরতে পারত না। তঁার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। আদালতের সমন থাকতে হবে। পরে আওয়ামী লীগ সরকারই নিবর্তনমূলক ধারা যুক্ত করে। এরপর সামরিক–অসামরিক সর সরকারই নাগরিক অধিকার খর্ব করতে একের পর এক আইন করেছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বিএনপি সরকার আইসিটি আইন করার সময় আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ করেছিল। তারা ক্ষমতায় এসে আইসিটি আইনকে আরও পোক্ত করল। এরপর সেখানেই থেমে থাকেনি, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করল, যা সাংবাদিক তো বটেই, যেকোনো নাগরিকের মুখ বন্ধ করার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে।
এরপর আসে দুর্নীতি। যে দেশে দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায়, সে দেশে দুর্নীতির প্রসার ঘটে। আর যে দেশে দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হয়, সেই দেশে দুর্নীতি কমে। গত ১২ বছরে উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতিও অনেক গুণ বেড়েছে। আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানো। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হওয়ার বদলে এর অস্তিত্বই বিলীন বিপন্ন হতে বসেছে।
১৫ সেপ্টেম্বর ছিল জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। এসব দিবসের মাধ্যমে জনগণ বিচার–বিশ্লেষণ করতে পারে, তারা কী ধরনের গণতন্ত্রে আছে। সেখানে মানুষ গণতন্ত্রের ন্যূনতম অধিকার ভোগ করতে পারছে কি না। তারা নির্ভয়ে সত্য কথা বলতে পারছে কি না। আবার ক্ষমতাসীনেরাও আত্মজিজ্ঞাসা করার সুযোগ পান, তাঁরা জনগণের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা কতটা পূরণ করেছেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে এক ধারা ছিল, হরতাল–অবরোধ। কিন্তু এরপর গত ছয় বছরে দেশে কোনো হরতাল–অবরোধ, ভাঙচুর, জ্বালাও–পোড়াও কিছুই হয়নি। তারপরও গণতন্ত্রের সূচকে আমাদের এ ক্রমাগত অবনতি কেন, এ প্রশ্নের জবাব কি ক্ষমতাসীনদের জানা আছে?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি