২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

অ্যাসাঞ্জের বিচারের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের মুখোশ খুলে গেছে

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
ফাইল ছবি।

ইতিহাসবিদ, সাবেক ব্রিটিশ কূটনীতিক ও মানবাধিকারকর্মী ক্রেইগ মিউরে অতি নীরবে সাধারণ মানুষের সেবায় যে অসামান্য অবদান রাখছেন, তাকে ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠার অনিবার্য অনুষঙ্গ বলা যেতে পারে।

লন্ডনের ওল্ড বেইলের ক্যাঙারু কোর্টে এই শতকের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচার চলছে। সেখানে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিচার হচ্ছে। এই বিচার নিয়ে গোটা সাংবাদিকতা জগতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা, সেখানে বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যম মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। আর এর মধ্যে সেই ক্যাঙারু কোর্টের পাবলিক গ্যালারিতে বসে ক্রেইগ মিউরে বিচারকাজ প্রত্যক্ষ করছেন এবং বিশ্ববাসীর সামনে সেই চিত্র তুলে ধরছেন।

গত এক সপ্তাহে মিউরের তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনগুলোতে দুটি প্রধান বিষয়বস্তু উঠে এসেছে। একটি হলো যুক্তরাষ্ট্র আসলেই কি অ্যাসাঞ্জের বিচার করতে চায় কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অপরটি হলো পশ্চিমা করপোরেট সংবাদমাধ্যমগুলো আদালতে অ্যাসাঞ্জের বিচারিক কার্যক্রমকে এড়িয়ে যাচ্ছে।

মিউরে তাঁর প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, অ্যাসাঞ্জের বিচার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বড় কোনো আওয়াজ দিয়ে নয়, বরং খুব নিঃশব্দে পশ্চিমা সাম্রাজ্যের ভদ্রলোকি মুখোশ খুলে গেছে। মিউরে তাঁর একটি প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘গত মঙ্গলবার মার্কিন সরকারের মুখোশ খুলে গেছে, যখন সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, সরকারের অতি গোপনীয় তথ্য ফাঁস করলে গুপ্তচরবৃত্তি আইনের (১৯১৭) আওতায় সব সাংবাদিককে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে।’ এখানে ‘সব সাংবাদিক’ মানে প্রত্যেক বৈধ সাংবাদিক ও প্রত্যেক নাগরিক।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই যুক্তি বিশ্লেষণ করে মিউরে বলেছেন, মার্কিন সরকার এখন আদালতে দাঁড়িয়ে বলে দিচ্ছে কোন কোন সাংবাদিককে আগেই জেলে পাঠানো দরকার ছিল এবং কোন কোন সাংবাদিককে শিগগিরই জেলে ঢোকানো দরকার। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আমরা কীভাবে সাংবাদিকতা করব, তা–ও তারা বাতলে দেওয়া শুরু করেছে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এবং নিউইয়র্ক টাইমস–এর মতো ‘গ্রেট লিবারেল মিডিয়া’খ্যাত ‘মহান উদার সংবাদমাধ্যমগুলোর’ কোনো সাংবাদিক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের শুনানিতে থাকছেন না এবং এসব পত্রিকা এই বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু লিখছেও না। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে তারা সংগঠিতভাবে বর্জন করেছে এবং সে কারণেই তাঁকে সাব হিউম্যান বা উপমানব ধরনের কিছু একটা ঠাওরে নিয়ে তাঁর পরিণতির বিষয়টিকে উপেক্ষা করে আসছে। এর পরে যে তারাও সরকারের রোষানলের শিকার হতে পারে, তারা কি তা না বোঝার মতো বোকা?

হয়তো তারা বোকা নয়। কিন্তু ওল্ড বেইলের শুনানির কোনো খবর প্রকাশ না করায় এতটুকু অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে তারা কাপুরুষ। তাদের নাকি ওই ক্যাঙারু কোর্টে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এই পশ্চিমা সাম্রাজ্য ইরাকে অবৈধ যুদ্ধ চালানোকে ‘বিক্রি’ করতে জুডিথ মিলারকে সবখানে যাওয়ার ‘প্রবেশের অনুমতি’ দিয়েছিল এবং একেবারে প্রথম পাতায় মিলারের প্রতিবেদনগুলো বড় করে নিয়মিত ছাপত। একইভাবে উবার-এর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত বব উডওয়ার্ডকে ইনসাইডার শীর্ষক বই লেখার জন্য সিআইএ সব ধরনের প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিল।

অ্যাসাঞ্জের বিচার নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো কী ধরনের একদেশদর্শী আচরণ করছে, তা মিউরে আগের প্রতিবেদনগুলোতেই খোলাসা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, আদালতের প্রেস গ্যালারিতে মাত্র তিনজন প্রতিবেদক থাকছেন। তাঁদের একজন হলেন শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক, আরেকজন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টের প্রতিনিধি। ক্রেইগ মিউরে পাবলিক গ্যালারিতে বসে বিচারকাজ দেখছেন।

অ্যামনেস্টি, পেন, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের মতো বিশ্বখ্যাত বেসরকারি সংস্থার কোনো প্রতিনিধিকে সেখানে সশরীর ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি অনলাইনেও শুনানির কার্যক্রম দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। অ্যাসাঞ্জের শুনানি যদি স্বচ্ছ হতো, তাহলে তারা প্রকাশ্যে তাঁর বিচার করত। নিদেনপক্ষে অনলাইনে তা সাংবাদিকদের দেখতে দেওয়া হতো। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো পশ্চিমা গণমাধ্যম পুরো বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, অ্যাসাঞ্জকে কাঠগড়ায় নবম দিনের মতো তোলার পর দ্য গার্ডিয়ান কোনো খবরই ছাপেনি। গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্সের ঘনিষ্ঠ দ্য টেলিগ্রাফও খবর ছাপেনি। দ্য ইনডিপেনডেন্ট ভেতরের পাতায় খুব ছোট করে একটা খবর ছেপেছে।

লক্ষণীয় হলো উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসকে জনসাধারণের জন্য ক্ষতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এখন পর্যন্ত এমন কাউকে উপস্থাপন করা হয়নি, যিনি উইকিলিকসের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

সব মিলিয়ে অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তার সঙ্গে বিচারকাজের আন্তর্জাতিক মানের আকাশ-পাতাল ফারাক।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
পেপে এসকোবার: ব্রাজিলের সাংবাদিক ও লেখক