অস্ট্রেলিয়ার ১ কোটি ৩০ লাখ ফেসবুকার গত বৃহস্পতিবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। কারণ, তারা এখন আবার ফেসবুকে খবর পড়তে পারছে এবং শেয়ার করতে পারছে। দেশটির ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আট দিন ধরে এই সুবিধা বন্ধ করে রেখেছিল। বলা যায়, রাগ করেই তারা অস্ট্রেলিয়া ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তৈরি করা কনটেন্ট ফেসবুকে শেয়ার করা বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা অস্ট্রেলীয় সরকারের স্বাস্থ্য ও জরুরি চিকিৎসাসেবা সংস্থাগুলোর ফেসবুক পেজগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল; সরকারি কোনো ওয়েবসাইটের কোনো কিছুই ফেসবুকে শেয়ার করতে দিচ্ছিল না।
ফেসবুকের এই রাগের কারণ, অস্ট্রেলিয়ার সরকার এমন একটা আইন তৈরির কাজ করছিল, যেটা কার্যকর হলে ফেসবুক, গুগলসহ সব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যমের তৈরি কনটেন্ট, মানে খবরজাতীয় লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য পয়সা দিতে হবে। এই আইন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে; গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আইনটির একটি খসড়া তৈরি হওয়ার পর গুগল আর ফেসবুক একসঙ্গে জানিয়ে দেয় যে তারা এ রকম কোনো আইন মানবে না। গুগল হুমকি দেয়, তারা অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে চলে যাবে। আর ফেসবুক হুমকি দেয়, তারা অস্ট্রেলিয়ার কোনো সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট তাদের প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করতে দেবে না।
গুগল-ফেসবুকের সঙ্গে অস্ট্রেলীয় সরকারের এই টানাপোড়েনকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বর্ণনা করা হলো একটা লড়াই বা যুদ্ধ হিসেবে। কে জিতবে এই লড়াইয়ে? অস্ট্রেলিয়ার সরকার কি গুগল-ফেসবুককে নিউজ কনটেন্টের জন্য পয়সা দিতে বাধ্য করতে পারবে?—এ রকমের প্রশ্ন নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলতে থাকল।
প্রযুক্তির যত রূপান্তরই ঘটুক না কেন, পেশাদার সাংবাদিকতা টিকে থাকবে প্রধানত এই কারণে যে মানুষের সংবাদপিপাসা কখনো ফুরাবে না
গুগলের পক্ষে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। কারণ, অচিরেই দৃশ্যপটে হাজির হলো আরেক প্রযুক্তি দানব মাইক্রোসফট—গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান। মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষ অস্ট্রেলীয় সরকারের আইনটির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলল, এই আইন কার্যকর হলে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজস্ব ভাগাভাগির একটা ন্যায্য বন্দোবস্ত নিশ্চিত হবে। খবর বেরোল, মাইক্রোসফটের চেয়ারম্যান অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে গুগল অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে চলে গেলে গুগল ক্রোমের শূন্যস্থান সানন্দে পূরণ করবে মাইক্রোসফটের সার্চ ইঞ্জিন ‘বিঙ’। ফলে গুগল কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে উঠল। তারা দেখল, অস্ট্রেলিয়ার বাজার মাইক্রোসফটের হাতে ছেড়ে দিয়ে ওই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চেয়ে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমকে কিছু রাজস্বের ভাগ দেওয়াই যথাযথ ব্যবসাবুদ্ধির পরিচায়ক হবে।
এভাবে গুগল অস্ট্রেলীয় সরকারের সঙ্গে লড়াইয়ের পথ ছেড়ে দিয়ে সমঝোতার পথে গেল। তারা অস্ট্রেলীয় সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগির বন্দোবস্ত চুক্তি করতে শুরু করল। কিন্তু ফেসবুকের যেহেতু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ায় কেন, বিশ্বের কোথাও নেই, তাই তারা সেই গোঁ ধরেই রইল: অস্ট্রেলীয় সরকারের ‘চাপিয়ে দেওয়া’ আইন তারা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। তারা বলে, সংবাদমাধ্যমগুলোর কনটেন্ট ফেসবুকে শেয়ার হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের যা লাভ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি লাভ হয় সংবাদমাধ্যমগুলোর। ফেসবুক অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর উইলিয়াম ইস্টন ফেসবুকের নিউজরুমের ফেসবুক অ্যাপ-এ ১৭ ফেব্রুয়ারি লেখেন, ফেসবুকের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট শেয়ার হলে ফেসবুকের যে ব্যবসায়িক লাভ হয়, তা খুবই সামান্য: ফেসবুকের নিউজ ফিডে ফেসবুকাররা যেসব কনটেন্ট দেখেন, পড়েন, শেয়ার করেন, তার মধ্যে সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট মাত্র ৪ শতাংশ। কিন্তু উল্টো দিকে, ২০২০ সালে মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ওয়েবসাইটে ঢুকেছেন প্রায় ৫১০ কোটি বার, যা থেকে সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর মোট প্রায় ৪০ কোটি ৭০ লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার আয় হয়েছে।
সংক্ষেপে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, ফেসবুকের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সম্পর্ক সংবাদমাধ্যমের পক্ষেই বেশি অনুকূল, তাই সংবাদমাধ্যমকে টাকা দেওয়ার জন্য ফেসবুককে বাধ্য করতে অস্ট্রেলীয় সরকার যে আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, সেটাকে তারা জবরদস্তি বলে মনে করে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আগাগোড়াই যা বলে আসছে, তার মোদ্দা কথা এ রকম: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও সংবাদমাধ্যমের মধ্যকার ব্যবসায়িক সম্পর্কের মধ্যে কোনো সরকারের নাক গলানো উচিত নয়। ফেসবুক সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগি ইতিমধ্যেই করে এবং ভবিষ্যতেও করে যাবে। কী হারে করবে, সেটা তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমঝোতার মাধ্যমে স্থির করে নেবে; সরকারের চাপিয়ে দেওয়া হারে নয়।
কিন্তু ফেসবুক কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্য অসম্পূর্ণ। আসলে তারা সংবাদমাধ্যমের কনটেন্টের জন্য সংবাদপ্রতিষ্ঠানকে যে অর্থ দেয়, তা খুবই সামান্য; এবং তারা তা দেয় নিজেদের মর্জিমাফিক। সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। অস্ট্রেলিয়ার সরকার যেসব কারণে আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এটাও একটা: সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট থেকে পাওয়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর রাজস্বের ওপর তার একক নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিয়ে রাজস্ব ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের দর-কষাকষির আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। অস্ট্রেলিয়ার ট্রেজারার জোশ ফ্রাইডেনবার্গ এটা পরিষ্কার করেই বলেছিলেন।
অবশেষে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে সেই আইন গত বৃহস্পতিবার পাস হয়েছে। ‘নিউজ মিডিয়া অ্যান্ড ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মস ম্যান্ডেটোরি বারগেনিং কোড ২০২১’ নামের আইনটিই পৃথিবীর প্রথম আইন, যা সাংবাদিকতার বিজনেস মডেলের রূপান্তর ও বিকাশের প্রক্রিয়ায়
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফেসবুক শেষ পর্যন্ত এই আইন মেনে নিয়েছে; তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, একদম শেষ মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে ‘সন্তোষজনক বোঝাপড়ার’ ফলে। আইনের খসড়াটিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথমত, সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো কী হারে পয়সা দেবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে না; সংবাদমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিজেদের মধ্যে দর-কষাকষি করে রাজস্ব ভাগাভাগির হার নির্ধারণ করবে, সে অনুযায়ী চুক্তি করবে। তারা সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে সরকার হস্তক্ষেপ করবে; সরকারই হার নির্ধারণ করে দেবে এবং তা মেনে নিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সংবাদমাধ্যম উভয় পক্ষ বাধ্য থাকবে।
অনেকে বলছেন, অস্ট্রেলীয় সরকারের সঙ্গে লড়াইয়ে অবশেষে ফেসবুক হেরে গেছে, জয় হয়েছে অস্ট্রেলীয় সরকারের। এবং এই দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশকেও একই ধরনের আইন প্রণয়নে উৎসাহ জোগাবে।
কিন্তু এটা আসলে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপিপাসু ফেসবুকারদের বিজয়। যা হলো, চূড়ান্ত বিচারে তা হলো তাদের সংবাদপিপাসার কারণেই। প্রযুক্তির যত রূপান্তরই ঘটুক না কেন, পেশাদার সাংবাদিকতা টিকে থাকবে প্রধানত এই কারণে যে মানুষের সংবাদপিপাসা কখনো ফুরাবে না।
● মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক