অপহরণ, নিখোঁজ, লাশ, বিজ্ঞাপন এবং পিছিয়ে পড়া গণমাধ্যম
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজফিডে চোখ রাখতেই গণমাধ্যমের একটি খবর চোখে পড়ল। অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের লাশ উদ্ধারের খবর। যুবকটির হাত, পা, চোখ বাঁধা। তাঁকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন ছবি গণমাধ্যমে দেওয়া উচিত নয়, অন্তত জার্নালিজমের এথিকস তা-ই বলে। তারপরও গণমাধ্যমটি সেই ছবি দিয়েছে। আর আমরাও মেনে নিয়েছি। কারণ, এমন লাশ উদ্ধারের কাহিনি এখন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমি নিজেও একজন ভুক্তভোগী। আমার সন্তানের লাশও উদ্ধার হয়েছে রেললাইনের পাশ থেকে এবং অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবেই।
আমার ছেলেটিও সাংবাদিকতা করত। ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন ওর নাম। দাদা, পরদাদা সাংবাদিকতায় ছিলেন, বাবা আছেন। ছেলেও পরম্পরাকে মেনে এসেছিল সাংবাদিকতায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতে হলো লাশ। অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ। সুতরাং ওই ছবি দেখতে আমার হৃদয় খুব একটা কাঁপেনি। যিনি তাঁর নিজের ছেলের কাটাছেঁড়া লাশ দেখেছেন, অন্য লাশের ছবি তাঁর গায়ে লাগে না। আর গণমাধ্যমে লাশের খবর, আর ছবি দেখতে দেখতে অন্য সবারও ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সয়ে যাওয়ার কারণেই গণমাধ্যমগুলো এখন সহজেই মৃতদেহের ছবি দিয়ে দেয়। যেন ধারণাটা এমন, ‘সাগরে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়।’
আমার ছেলে সাংবাদিকতা করত বলেই তার সহকর্মীরা, সহমর্মীরা তাকে নিয়ে অনেক খবর করেছেন, লিখেছেন, এখনো লিখছেন। কিন্তু আজ বা প্রতিদিন যে অজ্ঞাতনামা লাশের ছবি দেখছি, খবর পড়ছি, তার বেশির ভাগ খবরের আয়ুষ্কাল এক দিন বা দুদিন। তারপর আর কোনো ফলোআপ নেই। আমার জানতেও পারব না সেই অজ্ঞাতনামা জ্ঞাত হয়েছে কি না। এই যে অজ্ঞাতপরিচয় হওয়ার ঘটনাগুলো, তা আমাদের সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তেমনটা কেউ কি চিন্তা করে দেখেছেন বা দেখছেন?
নিজের সন্তান যখন ঘর থেকে বের হয়, তখন কি কারোরই চিন্তা হয় না সন্তানটি আমার সহিসালামতে ঘরে ফিরবে কি না? আমার কিন্তু হতো, সচেতনও ছিলাম। তারপরও শেষরক্ষা হয়নি। সুতরাং যাঁরা এখনো চিন্তা করছেন না, তাঁদের কারও পরিণতিও তো এমনটা হতে পারে। আমার মতো অসহ্য যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বাঁচতে হতে পারে। তাই বলি, এখনো সময় আছে, জেগে উঠুন। সময় গেলে কিন্তু সত্যিই সাধন হয় না।
দুই
আমার জেলা শেরপুরের নকলায় এক গর্ভবতী নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটানো হয়েছে। ফলে তাঁর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁকে অন্তত দুই সপ্তাহ কাটাতে হয়েছে হাসপাতালে। ঘটনাটি গত ১০ মের। আর আমরা জানতে পেরেছি ১২ জুন। তাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর। এমন নির্মমতার অনেক ঘটনা রয়েছে, যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ তা পোস্ট করে এবং ভাইরাল হয়, তখন আমাদের গাত্রোত্থান ঘটে। ‘চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে’র মতো। আমাদের গণমাধ্যমগুলো তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পিছু পিছু ছোটে।
একজন সাংবাদিক লিখলেন, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দখলে। কেন যাবে না? এই যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর তার পেছনে ছোটার প্রবণতা, তা তো গণমাধ্যমকে দৃশ্যমান পেছনে ফেলে দিয়েছে। সিটিজেন জার্নালিজমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে মেইনস্ট্রিম জার্নালিজম। এই বিপদটার কথা অনেক আগে থেকেই বলছিলাম। বছর সাতেক তো হলোই এমন কথা বলে আসার। প্রথমে অনেক ‘হোমরাচোমরা’, আমাদের সঙ্গে সেই কথাকে ‘তেলাপোকা’সম ভেবে পাত্তা দেননি, দিতে চাননি। এখন সেই হোমরাচোমরাদের আর কেউ পাত্তা দেয় না। তাঁদের লেখাও পড়ে না। নির্ভর করে গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ‘তেলাপোকা’দের কথা ও লেখার ওপর। ফলে সেই হোমরাচোমরারা এখন বাধ্য হয়েই নিজের প্রকাশিত লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেন। টক শোতে কখন যাবেন, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান দেন, অবলোকনের সবিনয় অনুরোধ জানান।
সে হিসেবেই বলি, ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন কাকে দেবেন, যেখানে মানুষের এনগেজমেন্ট বেশি, সেখানে; না যে মাধ্যম পিছিয়ে রয়েছে, তাতে? পণ্যের জন্য দরকার প্রচার, সুতরাং যেখানে পাবলিক বেশি, প্রচারও সেখানে বেশি। এসব চিন্তা করেই এখন গণমাধ্যমের পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে হবে। জো হুকুম বলবেন, না মানুষের কথা বলবেন, তা ঠিক করার দায়িত্ব এখন গণমাধ্যমের হর্তাকর্তাদেরই।
তিন
সর্বশেষ ঘটনা হলো সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের বোনের ছেলে অপহরণ। অবস্থা কতটা খারাপ হলে একজন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, যিনি সাবেক হলেও ক্ষমতাসীন দলেরই, তাঁর ভাগনে অপহৃত হয়। সেই মন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানাতে হয় উদ্ধারের দাবি। আকুতি জানাতে হয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছে। গণমাধ্যম এই ঘটনার গুরুত্ব দিয়েছে সোহেল তাজ ‘হাইপ্রোফাইলড’ বলে। ‘লোপ্রোফাইলে’র মানুষজনের অবস্থা তাহলে কী? তাদের খবর দুই দিন থেকে হাওয়া হবে না তো কী হবে! তাদের হারানো জন এবং তাদের খবর জ্ঞাত হওয়ার সম্ভাবনা তো সংগতই প্রায় শূন্যের কোঠায়। তারপরও হয়তো কেউ বলে বসবেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশে এত খবর রাখা বা দেওয়া কি সম্ভব!
সর্বশেষ সোহেল তাজের ভাগনে ফেরত এসেছেন। পরিবারটির মুখে হাসি ফিরেছে। তাদের প্রতি শুভকামনা। কিন্তু যাদের সন্তানেরা, স্বজনেরা এখনো ফিরে আসেনি বা আসবে না কোনো দিন, তাদের জন্য কী সান্ত্বনা?
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।