স্লোভাকিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি ইউরোপের ধারণার অতীত। ৩০ সেপ্টেম্বর ইউরোপের এই দেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, তার প্রভাব দেশটির সীমান্ত পেরিয়েও পড়বে। জনমত জরিপের ফলাফল যদি ঠিক হয়, তাহলে স্লোভাকিয়ার ক্ষমতায় রবার্ট ফিকো আবার ফিরছেন। ফিকো খোলাখুলি মস্কোর প্রশংসা করেন। প্রতিবেশী দেশ হাঙ্গেরির চরম ডানপন্থী নেতা ভিক্তর ওরবানকে তিনি মডেল বলে মনে করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো শিগগিরই নিজেদের ঘরের মধ্যেই নতুন গোলমাল সৃষ্টিকারীর দেখা পেতে যাচ্ছে।
২০২২ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে, তখন স্লোভাকিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। কিয়েভকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিবেদিত দেশ স্লোভাকিয়া। ন্যাটোর দেশগুলোর মধ্যে স্লোভাকিয়াই প্রথম ইউক্রেনে যুদ্ধবিমান পাঠায়। ফিকো নির্বাচিত হলে স্লোভাকিয়া ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাবে এবং ভ্লাদিমির পুতিনকে সমর্থন করবে।
৫০ লাখ লোকের দেশ স্লোভাকিয়ায় প্রোপাগান্ডার শক্তি কেমন, তা বোঝার একটি পরীক্ষাগার হতে পারে। গত বছর স্লোভাক সাংবাদিককে ক্রেমলিনের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য ঘুষ দেওয়ার জন্য হাতেনাতে আটক করা হয় প্রতিরক্ষাবিষয়ক এক কূটনীতিককে। একটি সংবাদমাধ্যমে ভিডিওটি প্রকাশ হলে সেটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং সেই কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়।
থিঙ্কট্যাংক গ্লোবসেক সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক আনুগত্য পরিমাপ করে। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে তহবিল পায়। প্রতিবছর তারা নাজুকতার একটি সূচক প্রকাশ করে। সম্প্রতি গ্লোবসেকে প্রকাশিত জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, স্লোভাকিয়ার ৫০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। কয়েক বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা অনেক বেশি। মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য প্রধানত দায়ী রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটা মনে করা মানুষের সংখ্যা নিম্নতম।
স্লোভাকিয়ায় নির্বাচনী হাওয়া শেষ মুহূর্তে নাটকীয় মোড় নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এখানে যে জটিল নির্বাচনী ব্যবস্থা, তাতে করে জোট সরকার গঠন খুব জটিল একটি বিষয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে ফিকো আবারও স্লোভাকিয়ার রাজনীতির প্রধান খেলোয়াড়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে রাজনীতি কতটা নোংরা হয়ে উঠেছে এবং ইউরোপের একেবারে কেন্দ্রে উদার গণতন্ত্রের ওপর মানুষ কতটা বিশ্বাস হারিয়েছে।
১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া অবলুপ্তির পর স্লোভাকদের নতুন স্বাধীন এই রাষ্ট্র এরই মধ্যে পশ্চিমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কমিউনিস্ট শাসন থেকে বেরিয়ে আসা রাষ্ট্রগুলো যখন প্রবলভাবে গণতান্ত্রিক শাসনকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে, সেখানে স্লোভাকিয়া পুরোপুরি ভিন্ন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট স্লোভাকিয়াকে ওই অঞ্চলের কৃষ্ণগহ্বর বলে অভিহিত করেছিলেন। দেশটিকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেরিতে দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে ন্যাটোর সদস্যপদ পায় স্লোভাকিয়া। সে বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ হয় দেশটি। ধারণা করা হয়েছিল যে স্লোভাকিয়া অবশেষে একটা সুস্থির পরিচয় ও জোট পেল।
এরপরই স্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এলেন ফিকো। আদি ও অকৃত্রিম জনতুষ্টিবাদী এক নেতা তিনি। ২০০৬ থেকে ২০১০ এবং ২০১২ থেকে ২০১৮ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি নিজের দেশের জনগণের উদ্দেশে পশ্চিমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্থিতাবস্থা যেন তাঁর দেশের বিপক্ষে না চলে যায়, সে বিষয়েও সতর্ক থেকেছেন।
এরপর যা হলো তা হচ্ছে, স্লোভাকিয়ার একেবারে মূল সত্তায় আঘাত। ফিকো সরকারের দুর্নীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভর্তুকি ও ইতালির মাফিয়াদের নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তরুণ সাংবাদিক জন কুসাক। ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বাইরে একটি ফ্ল্যাটে জন কুসাক ও তাঁর প্রেমিকা মার্টিনা কুর্সিরোভাকে ভাড়াটে খুনি গুলি করে হত্যা করে।
এ খুনের ঘটনায় স্লোভাকিয়ার জনগণ ফুঁসে ওঠেন। হাজার হাজার প্রতিবাদকারী রাস্তায় নেমে এসে ক্ষোভ জানাতে শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে ভেলভেট বিপ্লবের পর এত মানুষ রাস্তায় নামেন। যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের জর্জ সরোস বিক্ষোভে মদদ দিচ্ছেন, এ অভিযোগ আনার পর ফিকো ও তাঁর পুরো মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
যে আশা তৈরি হয়েছিল, সে আশা শিগগিরই দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। ২০১৯ সালের জুন মাসে পরিবেশকর্মী ও আইনজীবী জুজানা কাপুতোভা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হলেন। ক্ষমতায় বসার কয়েক মাসের মধ্যে মহামারি শুরু হলে সংকট শুরু হলো। গত চার বছরে স্লোভাকিয়ায় চারজন প্রধানমন্ত্রী আসেন। কোভিড মহামারি, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানিসংকট ও যুদ্ধের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারায় একের পর এক সরকারের পতন হয়। অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে শেষবার সরকারের পতন হয়, এরপর দেশটি রাজনৈতিকভাবে গভীর পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে।
ফিকোর ফিরে আসার আসার ইঙ্গিত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দল হিসাবে তিনি ইউক্রেনীয়দের ফ্যাসিস্ট বলে নিন্দা করতে শুরু করেন। একই সঙ্গে ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য স্লোভাকিয়া সরকার যে অস্ত্র সরবরাহ করছে, তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। কাপুতোভাকে তিনি আমেরিকান এজেন্ট বলে আক্রমণ করেন। তাঁর কণ্ঠে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। সম্প্রতি গোয়েন্দা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ফিকো, পুলিশের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হিসেবে বর্ণনা করেন। প্রায় দুই হাজার ফেসবুক পেজ থেকে পশ্চিমাবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়। রাশিয়ার সমর্থনে কাপুতোভার বিরুদ্ধে তথ্যের ঝড় তোলার হুমকি দেওয়া হয়।
নির্বাচনে ফিকোর দল স্মিয়ার-এসডি অন্যান্য দলের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। এ দলের উপপ্রধান লুবস ব্লাহার সঙ্গে সম্প্রতি আমার কথা হয়েছে। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের সংঘাতকে যতটা সামরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক সংঘাত বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এটিকে ইউক্রেনের ভূমিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি যুদ্ধ বলে মনে করি। এখানে ব্যাপারটা মোটেই রাশিয়া ও গণতন্ত্রের নয়। পশ্চিমাদের উদারনৈতিক বাতিকের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয় রক্ষার বিষয় এটি।’
স্লোভাকিয়ায় নির্বাচনী হাওয়া শেষ মুহূর্তে নাটকীয় মোড় নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এখানে যে জটিল নির্বাচনী ব্যবস্থা, তাতে করে জোট সরকার গঠন খুব জটিল একটি বিষয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে ফিকো আবারও স্লোভাকিয়ার রাজনীতির প্রধান খেলোয়াড়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে রাজনীতি কতটা নোংরা হয়ে উঠেছে এবং ইউরোপের একেবারে কেন্দ্রে উদার গণতন্ত্রের ওপর মানুষ কতটা বিশ্বাস হারিয়েছে।
জন ক্যাম্পনার ব্রিটিশ লেখক, বিশ্লেষক ও সম্প্রচারকর্মী
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত