আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মনে হয়, বিএনপি নামের দলটির নেতা-কর্মীরা অতিশয় নিরীহ, রাজপথ গরম করার মতো আন্দোলনের শক্তি-সামর্থ্য তাঁদের নেই। এ কারণে বিএনপির পদযাত্রাকে তাঁরা ‘মরণযাত্রা’, গণমিছিলকে ‘শোকমিছিল’ বলে উপহাস করেন।
অন্যদিকে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে যেভাবে একের পর এক মামলা দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে মনে হবে বিএনপির মতো দুর্ধর্ষ, দুর্বিনীত ও নাশকতা সৃষ্টিকারী দল বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। কোনটি সত্য?
নির্বাচনের আগে দেওয়া মামলার কারণ ব্যাখ্যার আগে দু-একটি উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। গত ২৯ আগস্ট রাতে আটক হন জামালপুর শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুর রহমান। পরের দিন নাশকতার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। ২ সেপ্টেম্বর অপর একটি মামলায় আসামি করা হয় মমিনুরকে। সেই মামলার এজাহার বলছে, ১ সেপ্টেম্বর রাতে নাশকতার উদ্দেশ্যে জামালপুর শহরের একটি মাঠে গিয়েছিলেন মমিনুর।
ডিবি পুলিশের মামলার ভাষ্য অনুযায়ী, মমিনুর কারাগার থেকে বেরিয়ে গিয়ে নাশকতার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বাস্তবে মমিনুর তখনো কারাগারে ছিলেন, এখনো কারাগারে আছেন। এর আগে একাধিক মামলায় পুলিশ এমন ব্যক্তিকে আসামি করেছে, যিনি অনেক আগেই মারা গেছেন। এই হলো বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কতিপয় অতি উৎসাহী কর্মকর্তার পেশাগত দায়িত্ব ও দক্ষতার নজির।
পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এতটাই পারঙ্গম যে কারাগারে আটক বিএনপির কর্মীকে দিয়ে নাশকতা ঘটাতে পারেন। কী হাস্যকর! সহিংসতা ও নাশকতার দায়ে জামালপুরে বিএনপির দুই হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩০টি মামলা হয়েছে। প্রথম আলোর জামালপুর ও সরিষাবাড়ী প্রতিনিধি সরেজমিনে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, মামলায় বর্ণিত যানবাহন ভাঙচুর কিংবা নাশকতার কোনো ঘটনা সেখানে ঘটেনি। মামলায় যেসব স্থানকে ঘটনাস্থল হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেখানে এমন কোনো জমায়েতও হয়নি। তাহলে কীভাবে ঘটনাস্থল থেকে আসামিদের আটক করা হলো। অথচ পুলিশ স্থানীয় লোকজনকে ভয় দেখিয়ে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে এবং তাঁদের কাছ থেকে সইও নিয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে অনেক জল্পনা ভেসে বেড়াচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। প্রকাশ্যে দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকলেও ভেতরে–ভেতরে আলোচনাও চলছে বলে নানা সূত্রে খবর আসছে। অন্তত বিদেশি দূতদের সামনে তো দুই দলের নেতারা বসছেন। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে যদি কোনো বোঝাপড়া হয়ও, দেড় লাখ মামলা ও ৪০ লাখ নেতা–কর্মীর মাথায় মামলার খড়্গ নিয়ে বিএনপি কি নির্বাচনে যেতে পারবে?
মো. রুহুল আমীন নামের একজন সাক্ষী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাটির বাদী এসআই নজরুল ইসলাম আমার পরিচিত। তিনি মোবাইলে ফোন দিয়ে আমাকে বাসা থেকে বের করেন। পরে ওই মামলায় সাক্ষী হতে বলেন। প্রথম দিকে আমি না করেছি। বলেছি, এখানে তো কিছুই হয়নি। তাহলে সমস্যা হবে না? তখন তিনি (এসআই) বলেন, “কোনো সমস্যা হলে আমি তো আছিই।”
‘এই আমি তো আছি’ আইনের শাসনের কত নম্বর ধারায় আছে, এসআই সাহেব জানালে বাধিত হতাম। এ ধরনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোর আরেক খবর বলা হয়, যেসব জেলায় পুলিশ বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে, সেসব জেলায় দলের কয়েক শ করে নেতা–কর্মীকে আসামি করে মামলা হয়েছে।
যে ঘটনা ঘটেনি, সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে মামলা করাকে বলা যায়, ভুয়া বা ‘গায়েবি মামলা’। আগে গ্রামে–গঞ্জে প্রতিবেশীদের মধ্যে ঝগড়া-বিরোধ থাকলে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা দিত। সেই গায়েবি মামলা এখন রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে।
২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় ‘গায়েবি মামলার’ কথাটি বেশ শোনা যেত। নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি দেখতে কুমিল্লা, টাঙ্গাইলসহ কয়েকটি এলাকায় যাই। সবখানে সরকারদলীয় প্রার্থীদের জোর প্রচার চলছিল তখন। বিরোধী দলের নেতা বা প্রার্থী কোথাও সমাবেশের চেষ্টা করলে মামলা দেওয়া হতো, বাড়িঘরে তল্লাশি চালানো হতো। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করতেই সবার মুখস্থ জবাব ছিল, ‘নির্বাচন তো হয়ে গেছে, ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।’ নির্বাচন হওয়ার আগে যখন ফল ঠিক হয়ে যায়, তখন কেউ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। ২০১৮–এর নির্বাচনে সেটাই হয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদক আসাদুজ্জামানের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সারা দেশে অসংখ্য মামলা করেছিল পুলিশ বাদী হয়ে। ওই নির্বাচনের আগের তিন মাসে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) কেবল ঢাকা মহানগরে নাশকতার অভিযোগে ৬৯৭টি মামলা হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরেই ঢাকায় মামলা হয়েছিল ৫৭৮টি। বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা এসব মামলা তখন ‘গায়েবি মামলা’ নামে পরিচিতি পায়। নির্বাচন সামনে রেখে ওই সময়ের মতো এবারও ‘গায়েবি’ মামলা করা হচ্ছে উল্লেখ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, এসব মামলার উদ্দেশ্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করা।
তবে এবারের ব্যতিক্রম হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও মামলার বাদী হচ্ছেন। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছেন। ঢাকায় গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বাদী হয়ে ৪০টি মামলা করেছেন। এসব মামলায় আসামি হিসেবে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ১ হাজার ৭০১ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা আরও ২ হাজার ৫৭৫।
গায়েবি মামলার পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আসামিও আইনের শাসনের ‘নতুন সংযোজন’। যেখানে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে সক্রিয়, সেখানেই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। নতুন মামলার সঙ্গে অনেক আগের ‘ঘুমন্ত’ মামলাগুলোও ‘জীবন্ত’ হয়ে উঠেছে। বিএনপির দাবি, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা ১ লাখ ৪০ হাজার মামলা করেছেন তঁাদের বিরুদ্ধে। মোট আসামি প্রায় ৪০ লাখ। একটি দলের ৪০ লাখ নেতা–কর্মী যদি নাশকতা, খুন, সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকেন, সেই দলের শক্তিটা ভাবুন।
আমাদের ধারণা, সরকার এসব মামলা দিয়ে বিএনপির বদলে আওয়ামী লীগকেই ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। বিএনপির মধ্যম সারির একজন নেতা বললেন, তাঁরা রাজনীতি করবেন কখন, সপ্তাহে দুই–তিন দিন আদালতের বারান্দায়ই থাকতে হয়। আগে এক মাস পর মামলার তারিখ পড়ত। এখন সপ্তাহে দুদিন। প্রথম আলোর ছবিতে দেখা যায়, জামালপুরের নেতা-কর্মীরা উচ্চ আদালতে হাজির হয়ে আগাম জামিন নিয়ে যাচ্ছেন। তবে সবাই জামিন পান না।
নির্বাচন সামনে রেখে অনেক জল্পনা ভেসে বেড়াচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। প্রকাশ্যে দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকলেও ভেতরে–ভেতরে আলোচনাও চলছে বলে নানা সূত্রে খবর আসছে। অন্তত বিদেশি দূতদের সামনে তো দুই দলের নেতারা বসছেন। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে যদি কোনো বোঝাপড়া হয়ও, দেড় লাখ মামলা ও ৪০ লাখ নেতা–কর্মীর মাথায় মামলার খড়্গ নিয়ে বিএনপি কি নির্বাচনে যেতে পারবে?
এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক মহলে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটি হলো বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে গায়েবি মামলা দেওয়া কিংবা ঘুমন্ত মামলাগুলো জীবন্ত করার উদ্দেশ্য কী? বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার কৌশল না নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি