ইতিহাস লেখা থাকবে, ২০২৪ সালটি ইরান, এর অক্ষশক্তি ও মিত্রদের জন্য যুদ্ধ-সংঘাতের ক্ষয়ক্ষতি এবং মর্যাদাহানি হওয়ার দিক থেকে অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় সবচেয়ে সংকটজনক বছর।
ইসরায়েল তার গাজা নির্মূলকরণ যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। গাজায় ইসরায়েলিদের নিষ্ঠুর হামলায় এ বছরেই নিহত হয়েছে ২০ হাজার মানুষ। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে একটা প্রতিবেদন দিয়েছে। গাজায় বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি গণহত্যার অভিযোগে দক্ষিণ আফ্রিকা মামলা করার পর এই আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।
গণহত্যামূলক যুদ্ধ অব্যাহত থাকায় রোজই হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মোট নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৫ হাজার হয়েছে। আহত হয়েছে এক লাখের বেশি। এ ছাড়া গাজার কয়েক লাখ বাসিন্দা তাঁদের আবাস হারিয়েছেন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলছে, গাজায় এখন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়বে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে খাবারের দাম যেভাবে বাড়ছে।
দখলদারির ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টর দেশ ইসরায়েল। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েল আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে দুই দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে। সে কারণেই দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বোমা হামলা করতে কোনো দ্বিধা করেনি। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হত্যা করে ইসরায়েল তাদের আগ্রাসন বিস্তৃত করতে পিছপা হয়নি। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে সরাসরি মিসাইল ও ড্রোন হামলা করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জর্ডান মিলে ইরানের মিসাইল ও ড্রোন মাঝপথেই ধ্বংস করে দিতে সহায়তা করে।
এটা ছিল ইরান ও তার মিত্রদের (বিশেষ করে সিরিয়া) লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলি হামলা প্রতিহত করার প্রচেষ্টা থেকে ভয় দেখানো।
হুতিরা তেল আবিব এবং ইলাতে মিসাইল ও ব্যালিস্টিক ড্রোন হামলা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ইয়েমেনে আক্রমণ করে।
আসাদ সরকার দুর্বল হওয়ার অর্থ হলো, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত ভূমিকা কী হবে, সেটা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হওয়া। যাহোক বাস্তবতা বলছে ইরান ও এর প্রক্সিদের প্রকল্প এখন ধোঁয়াশাপূর্ণ। তাদেরকে এখন ট্রাম্পের অভিষেক পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতে হবে।
যাহোক, সবচেয়ে কঠোর আঘাতটি আসে লেবাননে হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা এবং লেবাননে যুদ্ধ সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হলো হিজবুল্লাহ। দুই মাস ধরে চলা যুদ্ধে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবানন ও বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠ এবং এমনকি বৈরুতে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু বানায়। ২০০৬ সালের গ্রীষ্মকালে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যে মাত্রায় আগ্রাসন চালিয়েছিল ইসরায়েল, এবারের আগ্রাসন তার থেকেও ভয়াবহ। এবার তারা হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ এবং তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি হাশেম সাফিউদ্দিনকে হত্যা করে।
ইসরায়েলি এই আগ্রাসন হিজবুল্লাহর সঙ্গে লেবাননের সুন্নি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা অনৈক্য সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করে ইসরায়েল। গাজায় হামলা করে হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকেও হত্যা করে তারা। ইরান এরপর ইসরায়েলকে ঠেকাতে আবার প্রতিশোধমূলক হামলা করে। ইরান এখন ইসরায়েলের সর্বশেষ আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় আবারও প্রতিশোধমূলক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভয়ের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হিজবুল্লাহর সঙ্গে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন। ইরান ও এর প্রক্সিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাতটি ফ্রন্টে ইসরায়েল খানিকটা সফলতা পেয়েছে। ইসরায়েল তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য থেকে এই যুদ্ধ করছে। ইরানি হুমকির দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা, সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে সক্রিয় করা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং লেবানন ফ্রন্ট থেকে গাজা ফ্রন্ট পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে হামাস আন্দোলনকে একঘরে করে দেওয়া।
লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি এবং বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহুর হুমকির (বাশার আগুন নিয়ে খেলছেন) এক দিন যেতে না যেতেই সিরিয়ার বিরোধী বাহিনীগুলো সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে হতবাক করে দেওয়ার মতো আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছে আল-নুসরা ফ্রন্ট এবং হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। বিদ্রোহীরা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পোসহ আরও কিছু প্রধান শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। একই সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সিরিয়ার সেনা এবং ইরানি প্রক্সি ও সশস্ত্র যোদ্ধারা হয় আত্মসমর্পণ করেছেন, নাহয় পালিয়ে গেছেন। ফলে বিদ্রোহীরা কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই ট্যাংকসহ অন্যান্য অস্ত্র–সরঞ্জাম পেয়ে যায়।
আলেপ্পোসহ অন্যান্য শহর সিরিয়ার বিদ্রোহীদের কবজায় চলে যাওয়া আসাদ সরকার (রয়টার্সের সর্বশেষ খবর বলছে বিদ্রোহীরা দামেস্ক শহরে ঢুকে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দামেস্ক ছেড়েছেন) প্রক্সিদের জন্য বিরাট এক ধাক্কা। আলেপ্পো সিরিয়ার অর্থনৈতিক ও শিল্পশহর। ইদলিবের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় এটি বিদ্রোহীদের ক্ষমতার বড় কেন্দ্র হবে।
এটি পুরো দৃশ্যপটকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনীগুলোর ভূমিকা ও শক্তি বেড়েছে। আসাদ সরকারের অবস্থান দুর্বলতর হয়েছে। একই সঙ্গে ইরান ও এর প্রক্সিরা আবারও বড় ধাক্কা খেয়েছে।
সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, বিদ্রোহীদের এই হামলা ইসরায়েলি প্রকল্প, বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করছে। অন্যদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘লেবানন ও ফিলিস্তিনে পরাজয়ের পর আমেরিকা ও ইসরায়েল সিরিয়ার বিরোধী বাহিনীগুলো দিয়ে হামলার পরিকল্পনা করেছে।’
সিরিয়ার সরকারের প্রতি অনুগত বিশ্লেষকেরা দায়ী করছেন তুরস্ক এই হামলার পেছনে রয়েছে। যদিও তুরস্ক বলছে, এটা অপ্রত্যাশিত এক হামলা, এতে বেসামসরিক লোকেরা হুমকির মুখে পড়েছে।
সিরিয়ান বিদ্রোহীদের এ হামলাকে রাশিয়া সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা বলে বর্ণনা করেছে। সিরিয়া রাষ্ট্রকে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার দাবি জানিয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে ইরান ও এর অক্ষদের প্রভাব দুর্বল করার ক্ষেত্রে এবং তাদের সম্প্রসারণবাদী প্রকল্প ক্ষতি করার ক্ষেত্রে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধ চলমান আক্রমণ একটি বেদনাদায়ক ধাক্কা। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও এর প্রক্সিদের প্রভাব এবং ক্ষমতা দুর্বল ও ক্ষয়প্রাপ্ত হবে।
আসাদ সরকার দুর্বল হওয়ার অর্থ হলো, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত ভূমিকা কী হবে, সেটা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হওয়া। যাহোক বাস্তবতা বলছে ইরান ও এর প্রক্সিদের প্রকল্প এখন ধোঁয়াশাপূর্ণ। তাদেরকে এখন ট্রাম্পের অভিষেক পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতে হবে।
আবদুল্লাহ খলিফা আল-শাইজি, কুয়েত বিশ্বিবিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক
মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত