‘হারুন’। ‘জাঁকাইয়া’ তোলা এই নাম শুনলেই মনের রূপালি পর্দায় ওয়েব সিরিজের ‘ওসি হারুন’ থেকে শুরু করে দাঁত ভাঙা হারুনের চেহারা অটোম্যাটিক্যালি ফুটে উঠছে। হারুন মানেই যেন এখন ‘হয় মরুন নয় মারুন’ মেজাজের মারদাঙ্গা পুলিশ অফিসার।
তবে আপাতত ‘হারুন’ নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে যাঁর বদন আমার মতো মদন টাইপের মনে ভাসছে, তিনি হলেন ছাত্রলীগের ওপরের সারির একজন নেতার ওপরের পাটির দাঁত ভেঙে আক্ষরিক অর্থেই ‘দাঁত ভাঙা জবাব’ দেওয়া রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশিদ ।
হাত ভাঙলে জোড়া লাগে, দাঁত ভাঙলে লাগে না। আলোচ্য হারুন শুধু ছাত্রলীগ নেতার দাঁত ভাঙেননি, তিনি ছাত্রলীগের মনও ভেঙেছেন। ছাত্রলীগ নেতারা তাঁর সাজার দরখাস্ত করার পর তিনি বরখাস্ত হয়েছেন; যদিও তা ‘সাময়িক’।
এর আগে ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থীদের মারামারির সময় ‘গুলি শেষ’ বলার পর এক কনস্টেবলের গালে হারুন ঠাস করে চড় দিয়ে ধড় থেকে মাথাটাই ফেলে দিতে গিয়েছিলেন।
গত ৭ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে দাঁড়ানো ছাত্রদের হারুন ‘গো-পিটুনি’ দিয়েছিলেন। ছাত্রদের ‘বাবা গো, মা গো’ ডাকে ছাত্রলীগ এগিয়ে না এসে তখন হারুনের তালে তাল দিয়েছিল এবং হারুনের সেই অ্যাকশনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল।
গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে নামা বেকারসমাজের ওপরও হারুন ‘সিংগম’ স্টাইলে লাঠি ঠ্যাংগা নিয়ে ব্যাপক ঠ্যাঙানি দিয়েছিলেন। সে সময় ছবি তুলতে যাওয়া সাংবাদিকদেরও এক হাত নিয়ে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি।
এসব কারণে এডিসি হারুনের পিটুনিধর্মী জীবনালেখ্য নিয়ে ‘তিনি শুধুই পেটান’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট বেরিয়েছিল ডেইলি স্টার পত্রিকায়। তাতে অবশ্য তাঁকে বরখাস্ত হতে হয়নি, প্রত্যাহারের মুখে পড়তে হয়নি; ঊর্ধ্বতন কেউ তাঁকে ‘খবরদার, এসব দুষ্টুমি আর করবা না’ বলে মৃদু ভর্ৎসনা পর্যন্ত করেছে বলে শোনা যায়নি।
পিটিয়ে-পাটিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করতে পুলিশের মধ্যে কিছু ‘হিটার’ অফিসার লাগে বলেই হয়তো এসব ঘটনায় পুলিশ বিভাগে হারুনের বদনামের চেয়ে ‘নাম’ হয়েছিল বেশি। কিন্তু এবার একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটে গেছে। যে ছাত্রলীগের সঙ্গে হারুনের ঝুট-ঝামেলা থাকার কোনো কারণই থাকতে পারে না, সেই ছাত্রলীগ হুট করে তাঁর ওপর বেজায় বেজার হয়েছে।
সর্বশেষ এই ঘটনায় এডিসি হারুন ও তাঁর সহকর্মীদের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তাঁদের মধ্যে আনোয়ার হোসেনের অবস্থা খুব খারাপ।
এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে পরিষ্কার, এই ঘটনার সঙ্গে মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ, সরকারি দল-বিরোধী দল—ইত্যাকার জনসম্পৃক্ত কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ব্যাপার নেই। এই ঘটনা অতি ব্যক্তিগত ও আড়াল আবডাল পর্যায়ের। বলা যায়, এই ঘটনা একেবারে ঘরোয়াঘটিত ও দাম্পত্যজনিত।
জানা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের দাম্পত্য জটিলতায় এডিসি হারুন ঢুকে পড়েছিলেন। আজিজুলের স্ত্রী (তিনিও পুলিশের একজন কর্মকর্তা) ও হারুন বারডেম হাসপাতালে দেখা করছেন শুনে আজিজুল হারুনকে শাসানি দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ নেতাদের বারডেম হাসপাতালে ডেকে নিয়েছিলেন। সেখানে আজিজুল ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে হারুনের ঝগড়াঝাঁটি ধস্তাধস্তি হয়। পরে হারুন পুলিশ ফোর্স ডাকেন। পুলিশ এসে ছাত্রলীগের একজনকে থানায় নিয়ে যায়।
‘কুমির যেমন খাঁজ কাটা দাঁতের মধ্যে শিকারকে বিদ্ধ করিয়া জলের তলে অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি করিয়া হতভাগ্যকে চাপিয়া ধরিয়া অতলস্পর্শ থানার মধ্যে অন্তর্হিত হওয়াই পুলিশ কর্মচারীর স্বাভাবিক ধর্ম’—এই রাবীন্দ্রিক বাণী ওই নেতা তখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন। পরে বাকি দুই নেতা থানায় এলে সেখানে হারুন ও অন্য পুলিশ সদস্যরা তাঁদের বেধড়ক পেটান।
ঘটনার পর হারুনকে দুই দফা বদলি করা হয়। এর পর ছাত্রলীগ নেতাদের নালিশের জের ধরে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
হারুন কামলা গোছের কেউ নন বরং আমলা পর্যায়ের অফিসার; তাই হয়তো ভয়ংকর ফৌজদারি অপরাধের পরও এখন পর্যন্ত তাঁর নামে মামলা হয়নি। মামলা হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ছাত্রলীগ বা ভুক্তভোগীরাও হারুনের বিরুদ্ধে মামলা করবেন—এমন কোনো আলামত আপাতত নেই।
এই পুরো ঘটনার মধ্যে নিশ্চয়ই চিন্তাশীলদের ভাবনার নিদারুণ নিদর্শন রয়েছে। খেয়াল করুন, রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা হয়ে একজন পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে নালিশ করতে গেছেন ছাত্রলীগের ক্যাডারদের কাছে।
কোনো মানুষ তার প্রতিপক্ষকে নিজের চেয়ে বলশালী মনে করলে সে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে প্রতিপক্ষের চেয়ে বলশালী কাউকে সাহায্য করতে ডাকে বা ভাড়া করে আনে। সেই তত্ত্ব অনুসারে, আজিজুল প্রতিকারের জন্য প্রশাসন কিংবা পুলিশের কাছে না গিয়ে গ্রাম্য কায়দায় ছাত্রলীগের ‘ছোট ভাইদের’ ডাকায় বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা খোদ মহামান্য রাষ্ট্রপতির একান্ত সহকারীর চোখে ছাত্রলীগের নেতারা পুলিশ-প্রশাসনের চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখেন। প্রশাসন ক্যাডারের লোক নিজের মুশকিল আসান করতে গেছেন ছাত্রলীগের ক্যাডারের কাছে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এডিসি হারুন ছাত্রলীগ নেতাদের শক্তিকে রাষ্ট্রপতির এপিএসের চোখে ভক্তিভরে দেখতে রাজি হননি। পুলিশের ওপর দাদাগিরি করতে যাওয়ায় তিনি ছাত্রলীগ নেতাদের ‘দাঁত ভাঙা জবাব’ দিয়ে দেন।
এডিসি হারুন, রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল ও আজিজুলের স্ত্রী—এই তিনজনই বিসিএস ক্যাডার এবং যথারীতি তিনজনই ভালো আছেন, সুস্থ আছেন, সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছেন। আজিজুল সস্ত্রীক আলোচনার কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যে সরেও গেছেন। কিন্তু দাঁত হারানো ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ারকে হাসপাতালে ধুঁকতে হচ্ছে। তাঁর চিকিৎসার খরচ সরকারও দেবে না, ছাত্রলীগও দেবে না; দিতে হবে তাঁর পরিবারকে।
আরও খেয়াল করার বিষয় হলো, এই ঘটনাকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁদের ‘হায়ারে’ যাওয়া সতীর্থদের প্রতি পুলিশের ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’ হিসেবে দেখছেন বলে মনে হচ্ছে।
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এডিসি হারুন তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের ঝামেলা সামাল দিতে গিয়ে পুলিশের মতো একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ক্ষমতা, অস্ত্র, স্থাপনা, যান, লোকবল ও অন্যান্য সফট পাওয়ারের ব্যবহার করেছেন। এটি নিয়েও তেমন কোনো আলাপ আলোচনা নেই।
থানার ভেতরে কাউকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা ও দাঁত ভেঙে ফেলা ফৌজদারি অপরাধ জেনেও ছাত্রলীগ মামলা করেনি। মজার বিষয় হলো, এ নিয়ে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি নিন্দাসূচক কোনো বিবৃতি না দিলেও ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়ন বিবৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ ঘটনাটিকে ব্যক্তি পর্যায়ের এই ঘটনাকে প্রত্যেক শিবির থেকেই সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এডিসি হারুনের বিরোধিতা করাকে পুলিশ বাহিনীর বিরোধিতা করা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সাদা চোখে মনে হচ্ছে, পুলিশ বাহিনী এডিসি হারুনকে যতটা ‘ওউন’ করছে, সে তুলনায় ছাত্রলীগ দাঁত হারানো আনোয়ারকে ততটা নিজের মনে করছে না। কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে’ ছাত্রলীগ বিষয়টি নিয়ে আগাচ্ছে। তাঁদের ভাষায় ‘এটা পরিণত আচরণ’।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মধ্যযুগীয় মারামারি নাটকের পাত্র-পাত্রীদের সবাই উচ্চশিক্ষিত। এদের মধ্যে এডিসি হারুন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। তিনি শেলি, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ফ্রস্ট, কীটস্-এর রোমান্টিক কবিতা পড়ে আসা মানুষ।
প্রতীচ্যের জীবনানন্দ ওয়ার্ডওয়ার্থের কবিতার সঙ্গে চড়িয়ে থাপড়িয়ে পাবলিকের দাঁত ফেলে দেওয়ার যে মেলবন্ধন তিনি ঘটিয়েছেন তা ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। সাহিত্যের সুশীল ছাত্রের এই ধরনের অ্যাকশনধর্মী পারফরম্যান্স দেখে মনে হচ্ছে, কীটস্ পড়ার পর তিনি পাবলিককে তো বটেই, এমনকি ছাত্রলীগকেও ‘কীট’ মনে করেন। মনের চোখে দিব্যি দেখছি, এডিসি হারুন ছাত্রলীগ নেতাদের পতঙ্গজ্ঞানে বলছেন: ‘ইউ অল আর কীটস্’।
তবে কথা হলো হারুনের এই অসাহিত্যিক আচরণ আর উল্টোপাল্টা কাহিনি পুলিশ বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলছে। তাঁর সর্বশেষ কাহিনি তদন্তে ডিএমপি যে তদন্ত কমিটি করেছে, এই বিষয়টি তাঁদের মাথায় রাখতে হবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]