‘স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরিহিত শিক্ষার্থী লেকের ভেতর প্রবেশ নিষেধ’—ঠিক এমন একটি ফরমান ঝুলছে ধানমন্ডি লেকের ল্যাম্পপোস্টে। চলতি পথে চোখে পড়ায় মনে হলো ভুল কিছু দেখছি কি না। না, খুবই স্পষ্ট করে, লাল কালির অক্ষরে জারি করা হয়েছে নির্দেশনাটি।
প্রথমেই ভাবনায় এল, একটা জনপরিসরে এভাবে কাউকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া কতটা শোভন সিদ্ধান্ত? স্কুল-কলেজের পড়ুয়া, মানে শিশু-কিশোরেরা কী এমন হুমকি তৈরি করেছে যে তাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একেবারে নোটিশ টাঙিয়ে দিতে হবে?
ল্যামিনেশন করা কাগজে আরও নির্দেশনাসহ বিজ্ঞপ্তিগুলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, মাননীয় সংসদ সদস্য ঢাকা-১০, ধানমন্ডি মডেল থানা ও ধানমন্ডি সোসাইটির নামে জারি করা হয়েছে। তার মানে হলো, উঁচুতলার কর্তৃপক্ষই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার কারণ কী কর্তৃপক্ষ কিছু জানাইনি। ধরে নিই যে, স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে যারা লেকে ঘুরতে আসে, তাদের ঠেকাতে গিয়েই এমন সিদ্ধান্ত। তাদের নিয়ে হয়তো অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষগুলোও চিন্তিত। কিশোর বয়সীদের বিপথে যাওয়ার শঙ্কাও আছে। সাম্প্রতিক কালে কিশোর বয়সীরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, নানা গ্যাং বানাচ্ছে এবং ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তাদের ব্যবহার করছে। কিন্তু তাই বলে কি ইউনিফর্ম পরিহিত শিক্ষার্থীদের ‘প্রবেশ নিষেধ’ লিখে নোটিশ টাঙাতে হবে?
সংসদ সদস্য বলি, সিটি করপোরেশন বলি কিংবা পুলিশ আর ধানমন্ডি সোসাইটি বলি, এ ক্ষেত্রে কি তারা কোনো সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তারা ধানমন্ডি লেকের ভেতরে ও বাইরে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ করেছে।
প্রায় দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল ঢাকায় দু-একটি জনপরিসর এখনো টিকে আছে, তার মধ্যে একটি ধানমন্ডি লেক। রাসেল স্কয়ারের ওই দিকটা দিয়ে কেউ যদি লেকে যেতে চান, তাঁকে নাক-মুখ হাত দিয়ে ঢেকে কিংবা রুমাল চেপে ঢুকতে হয়। সারি সারি ময়লার গাড়ি আর জমাট দুর্গন্ধ। দুনিয়ার আর কোথাও উদ্যান বা লেকের প্রবেশমুখে ময়লার ভাগাড় বা ময়লা শোধনাগার করার মতো অদ্ভুত চিন্তা কেউ করতে পারবে?
স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে কেউ যদি লেকে আসে, তার দায়টা কি শুধুই শিক্ষার্থীদের। বহুতল একেকটা ভবন বানিয়ে আমরা সেগুলোর নাম দিয়েছি স্কুল-কলেজ। খেলাধুলা তো দূরে থাক, ঢাকার কয়টা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটু জোরে শ্বাস নেওয়ার মতো জায়গা আছে? গানবাজনা, সাংস্কৃতিক কাজ, বিতর্ক, ছবি, আঁকা, দেয়ালপত্রিকা কিংবা বিজ্ঞানচর্চা—কোন কাজটা করার ব্যবস্থা আছে?
তাহলে এই হাজার হাজার ছেলেমেয়ে শুধু ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে শ্রেণিকক্ষে বসে শিক্ষকের কথা তোতাপাখির মতো মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখবে! কোনো স্কুল-কলেজ থেকে ক্লাস চলাকালে শিক্ষার্থীরা কেন বের হয়, সে প্রশ্ন না করে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেই কি সবটা দায়িত্ব পালন করা হয়। প্রশ্ন হলো, ধানমন্ডি লেকে প্রবেশ করতে না দিলেই কি ছেলেমেয়েরা স্কুল পালানো বন্ধ করে দেবে? স্কুল-কলেজ ছুটি শেষে তারা যদি লেকে বেড়াতে আসতে চায়, ইউনিফর্ম গায়ে থাকলে সেটা কি তারা পারবে?
প্রায় দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল ঢাকায় দু-একটি জনপরিসর এখনো টিকে আছে, তার মধ্যে একটি ধানমন্ডি লেক। রাসেল স্কয়ারের ওই দিকটা দিয়ে কেউ যদি লেকে যেতে চান, তাঁকে নাক-মুখ হাত দিয়ে ঢেকে কিংবা রুমাল চেপে ঢুকতে হয়। সারি সারি ময়লার গাড়ি আর জমাট দুর্গন্ধ। দুনিয়ার আর কোথাও উদ্যান বা লেকের প্রবেশমুখে ময়লার ভাগাড় বা ময়লা শোধনাগার করার মতো অদ্ভুত চিন্তা কেউ করতে পারবে? কিন্তু আমাদের নগর অভিভাবকেরা অনায়াসে লেকের প্রবেশমুখে ময়লা শোধনাগার বানিয়ে রাখতে পারেন।
ধানমন্ডি লেকে সকাল-বিকেল-সন্ধ্যায় অনেকে নিয়ম করে হাঁটেন, দৌড়ান, ব্যায়াম করেন। এর বাইরে কিশোর বয়সীদের একটা ভিড় থাকে। তাদের কেউ ফুটবল খেলে, কেউ ক্রিকেট খেলে। কেউ সাইকেল চালায়। কেউবা আবার গিটার হাতে গলা ছেড়ে গান গায়। আড্ডা, গল্পের ফোয়ারা ছোটায় একেকটা গ্রুপ। পানি, ঝরা পাতা, গাছগাছালি, ফুল, পাখি আর বিচিত্র ধরনের মানুষের সম্মিলন ধানমন্ডি লেক যে প্রাণময় হয়ে ওঠে, তার একটা বড় কারণ তাদের উচ্ছল উপস্থিতি।
আমাদের কর্তাব্যক্তিরা কথায় কথায় মুখে ফেনা তুলে ফেলেন শিশুদের জন্য—আগামী প্রজন্মের জন্যই তাদের সবকিছু। অথচ বাস্তবে আচরণটা পুরোপুরি ভিন্ন। এটা শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল আচরণ। এই মনোভাবই নাক-উঁচু দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। সে কারণেই কেউ ভিক্ষুক নিষিদ্ধ করার কথা বলেন। কিন্তু কাউকে যাতে ভিক্ষার জন্য হাত পাততে না হয়, তার জন্য কি দায়িত্বটা তাঁরা পালন করছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা বলেও তো কিছু আছে।
প্লাস্টিক নিষিদ্ধের যে নির্দেশনা জারি করেছে, সেটা লেকের স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত জরুরি। ফরাসি প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে ধানমন্ডি লেকে যাওয়ার কথা ছিল। সে সময় লেকের তলদেশ খুঁড়ে কয়েক ট্রাক প্লাস্টিক উদ্ধার করা হয়েছিল। বাইরে থেকে খাবার ও পানি এনে লোকে লেকে প্লাস্টিক ফেলে। সবচেয়ে বড় প্লাস্টিক দূষণের কারণ কর্তৃপক্ষের কাছে অজানা কি?
লেকের ভেতরের বিভিন্ন জায়গা খাবার দোকানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেসব দোকান খাবার, পানি ও চা বিক্রিতে প্লাস্টিকের দেদার ব্যবহার করছে। লেককে প্লাস্টিকের জঞ্জালমুক্ত করতে গেলে খাবারের দোকানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা সবার আগে জরুরি। ল্যাম্পপোস্টে নির্দেশনা ঝুলিয়ে দিলেই তা ম্যাজিকের মতো বাস্তবায়িত হয়ে যাবে—সে ভাবনার ভূত মাথা থেকে তাড়াবে কে?
জনপরিসরে ধূমপানের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা আর বাস্তব কাজের মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে। লেকের ভেতরে খাবার দোকানের পাশে সিগারেটের দোকান বসিয়ে কীভাবে ধূমপানমুক্ত লেক করা যাবে, তা মাথায় আসে না। ল্যামিনেশন করা কাগজে প্লাস্টিক নিষিদ্ধের বিজ্ঞাপন লটকে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের চিন্তাটি যে উদ্ভট, সেটা কি তারা বুঝতে পারে?
তবে সবার আগে, শিক্ষার্থীদের লেকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার আগে একবার অন্তত অস্কার ওয়াইল্ডের শিশু ও স্বার্থপর দৈত্যের গল্পটা পড়ি নিতে পারেন।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী