বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে উৎসাহ জোগাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ২৪ মে নতুন যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছেন, তার যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, সেটা আগে থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির সমর্থকেরা এই পদক্ষেপের তাৎপর্য খারিজ করে দিয়ে দাবি করেছেন, নতুন এই ভিসা নীতি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারে সমর্থন জোগাবে। একই সঙ্গে বিরোধীদের সতর্ক করে দিয়ে তাঁরা বলছেন, ভোটের সময় বিরোধীরা যদি সহিংসতা করে, তাহলে তাদের ওপরও ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা হতে পারে।
সরকারের সমালোচকেরা ভিসা নীতিকে ব্যাখ্যা করে বলছেন, বিরোধীদের দিকে যুক্তরাষ্ট্র যে সমর্থন বদল করেছে, নতুন এই ভিসা নীতি তারই ইঙ্গিত। অতীতে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে এ ঘোষণাকে একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকায় দেশটির দূতাবাস, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে, এই দুই চরম অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেছে। অন্য আন্তর্জাতিক বন্ধুরা এখন পর্যন্ত নীরব, অনেকে সময় নিচ্ছে এবং কোন দিকে ঘটনা গড়াচ্ছে, সেটা দেখছে।
অন্য যেকোনো নীতির মতোই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই ভিসা নীতির চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করবে, সেটা কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, তার ওপর। এই ভিসা নীতির প্রয়োগ যাঁরা করতে যাবেন, তাঁদের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জটি হবে, ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের জন্য পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করা। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের জনাকয়েক লোকের পক্ষে নির্বাচনী রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা তদন্ত ও মূল্যায়ন করা হবে ভয়ংকর কঠিন এক কাজ। সারা দেশ ভ্রমণ, নিরাপত্তা বিবেচনা, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা এবং এসব ঘটনায় অসংখ্য মানুষের জড়িত থাকা—এসব বিবেচনায় কাজটি অনেক জটিল হবে।
বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের মতো করেই যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ের জন্য শেষপর্যন্ত নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের নেটওয়ার্কের সহযোগিতা নিতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ও পাল্টা দাবিতে ভরে উঠবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। প্রতিটি দলই তাদের পরবর্তী রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যেন পদক্ষেপ নেয়, সেটা চাইবে। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের যে চিত্র, তা থেকে স্পষ্ট যে দোষ বিচার করা কতটা কঠিন হবে।
উপরন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনজীবী ও নীতিনির্ধারকদের কোন মানের তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন এবং ভিসাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে কতটা শ্রম দেওয়া দরকার, সে বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক যে বাস্তবতা, তাতে করে বেছে বেছে বিধিনিষেধ আরোপের পথ অনুসরণ করার সম্ভাবনাই বেশি, নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অন্যান্য ঘটনায় যেমনটা দেখা গেছে।
ভিসা নীতি কতটা সফল হবে, তার সত্যিকারের পরীক্ষার ক্ষেত্র হলো, এটা আরও রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং আরও ভালো নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখছে কি না। সেটা নিশ্চিত করতে হলে সরকার ও বিরোধী দল— দুই পক্ষের নীতিনির্ধারক এবং তাদের নির্দেশাবলি যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, তাঁদের ওপর প্রভাব পড়ে এমন পদক্ষেপ দরকার।
ভিসা বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে। কাউকে ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তথ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে কি না এবং নীতি ও আইনে যে ধারা আছে, সেগুলো যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পাল্টাপাল্টি দাবিগুলো যাচাই করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শেষ করতে কত দিন লেগে যাবে, সে বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে ভিসা নীতি কতটা সফল হবে, তার সত্যিকারের পরীক্ষার ক্ষেত্র হলো, এটা আরও রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং আরও ভালো নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখছে কি না। সেটা নিশ্চিত করতে হলে সরকার ও বিরোধী দল— দুই পক্ষের নীতিনির্ধারক এবং তাদের নির্দেশাবলি যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, তাঁদের ওপর প্রভাব পড়ে এমন পদক্ষেপ দরকার। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার, যাতে একটা স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বদলের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি এককভাবে যথেষ্ট, এমন ভাবা ঠিক হবে না।
এখনো নিষেধাজ্ঞার ভীতিটা বাস্তব এবং যাঁদের পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্র না গিয়ে উপায় নেই তাদের জন্য যদি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায়, তার প্রভাব হবে অনেক বড়। এটা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে যদি সমমনা দেশগুলো (যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি) একই পথ অনুসরণ করে। রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক ছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জনপ্রশাসনের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় (তাদের পরিবারের সদস্যও) বিদেশে যেতে পারবেন না, সেটা ভাবা তাঁদের জন্য সুখকর হবে না। যে শীর্ষ খুঁটিগুলো সরকার ও বিরোধী দলকে সমর্থন দেয়, সেগুলো যদি দুর্বল হতে শুরু করে তাহলেই প্রকৃত পরিবর্তনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা বড় হবে।
এসব প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও সার্বিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই ভিসা নীতি একটি স্বাগত জানানোর মতো পদক্ষেপ এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে এটি যে কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়, সেই ইঙ্গিত এতে মিলছে।
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, দিল্লির দিক থেকে প্রতিবাদ আসতে পারে, তা জানা সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন নতুন পদক্ষেপের দিকে এগিয়েছে। অতীতে বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে দৃশ্যত ভেটো প্রদান করে এসেছে ভারত। প্রতিবেশী ইস্যুতে ওয়াশিংটন ও দিল্লির অবস্থানগত পার্থক্যের কারণে ভারত এই ভেটো দিয়েছে।
বাইডেন প্রশাসন ভারতের সঙ্গে যখন তাদের সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তখন তারা এই বার্তাও দিতে চেয়েছে যে বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে একমত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। এখন অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বন্ধুদের ক্ষেত্রেও সময় এসেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে সমর্থনের অঙ্গীকার করা।
জন ডানিলোভিকজ সাউথ এশিয়ান পারসপেকটিভস-এর এডিটর আট লার্জ এবং ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক ডেপুটি চিফ অব মিশন
সাউথ এশিয়ান পারসপেকটিভসে প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত