থাইল্যান্ডের মতো ভূমিকম্পে ঢাকার কী পরিণতি হতে পারে

শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে মুহুর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বহুতল ভবন। ব্যাংকক, থাইল্যান্ড। শুক্রবার, ২৮ মার্চছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় যেভাবে গাজার বহুতল ভবনগুলো মুহূর্তেই মাটির সঙ্গে মিশে যায়, তেমনটিই যেন দেখা গেল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। তবে এটি কারও কোনো হামলা নয়, নয় কোনো বিস্ফোরণের ঘটনাও। এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে মাটির সঙ্গে মিশে গেল ব্যাংককের ৩০ তলা একটি ভবন। প্রায় একই উচ্চতার একটি ভবনের ছাদের সুইমিংপুল থেকে যেভাবে পানি ছিটকে নিচে পড়ল, তাতেও শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না।

শুক্রবার থাইল্যান্ডের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের শহর ব্যাংকক কাঁপিয়ে দেওয়া এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারের মান্দালয়ে। ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৭।  ব্যাংককে ভবনধসে চাপা পড়েছেন শতাধিক মানুষ।

মিয়ানমারে কয়েকটি শহরে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশটিতে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। সেখানেও অনেক বহুতল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

মিয়ানমারের এ ভূমিকম্প থাইল্যান্ড ছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনামের বিভিন্ন শহরে অনুভূত হয়েছে। এ থেকেই স্পষ্ট হয়, ভূমিকম্পটির প্রভাব কী বিস্তৃত ছিল।

এ ভূমিকম্পের ধাক্কা বাংলাদেশে অনুভূত হয় শুক্রবার দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে। উৎপত্তিস্থল ৫৯৭ কিলোমিটার দূরে হলেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর বেশ ‘কম্পন’ দেখি আমরা। কে ভূমিকম্প টের পেল আর কে টের পেল না, এ নিয়ে হাস্যরস তো আছেই। কিন্তু এই দুশ্চিন্তা বা আশঙ্কাও উঠে এসেছে, থাইল্যান্ডের মতো ভূমিকম্পের ধাক্কায় ঢাকার কী পরিণত হতে পারে?

ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারের ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প বাড়লেও গত ২০ বছরে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, এমন নজির নেই। তাই এবারের এ ভূমিকম্প বেশ বড় ভূমিকম্প। যে কারণে এর প্রভাব বিস্তীর্ণ এলাকায় পড়েছে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং হিমালয়ের পাদদেশের এলাকাগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ। দেখা যাচ্ছে, এসব স্থানে ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে।

এখন আরও বড় ভূমিকম্প হলে তার প্রভাবও নিশ্চয়ই আরও জোরালোভাবেই প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। অথবা একই মাত্রার ভূমিকম্প যদি আরও কম দূরত্বে উৎপত্তি হয়, তখন ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর কী অবস্থা হতে পারে, একবার ভাবুন তো? যত ধরনের অপরিকল্পনা আছে, সবকিছু নিয়েই রাজধানী ঢাকা গড়ে উঠেছে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে দুই কোটির অধিক মানুষ নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী শহর।

বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা তখন বিস্ফোরণের শহর হয়ে উঠবে তা অবধারিত। কারণ এখানকার পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা এতই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে, বড় মাত্রার ভূমিকম্পে যে বিপর্যয় নেমে আসবে তা আসলে কল্পনাতীত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বঙ্গবাজার মার্কেটের আগুন, মগবাজারের বিস্ফোরণ, সিদ্দিকবাজারের মার্কেটে বিস্ফোরণ, বেইলি রোডের রেস্তোরাঁ মার্কেটে বিস্ফোরণে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা তো আমরা দেখলামই।

ঢাকায় বড় ভূমিকম্প হলে কী করুণ পরিস্থিতি হতে পারে, তা উঠে আসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নেওয়া এক গবেষণামূলক প্রকল্পে। ২০২৪ সালের ৩১ মে এ প্রকল্পের আওতায় ভূমিকম্প সহনশীল নগরায়ণ বিষয়ে দুই দিনের আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে রাজউক। সেখানে গবেষণা ও জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন গবেষকেরা। সেখান থেকে আমরা জানতে পারছি, মিয়ানমার বা থাইল্যান্ডের আজকের ভূমিকম্প থেকেও আরও অনেক কম মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার মোট ভবনের ৪০ শতাংশই ধসে পড়বে।

গবেষকেরা বলেছেন, দেশে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। এই ভূমিকম্প হয়েছিল টাঙ্গাইলের মধুপুরের ভূগর্ভস্থ চ্যুতি বা ফাটল রেখায় (ফল্ট)। এরপর ১৩৯ বছর হতে চললেও এত বড় ভূমিকম্প ওই ফাটল রেখায় আর হয়নি। মধুপুরের ওই ফাটল রেখায় যদি রিখটার স্কেলে (ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপক) এখন ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়, তাহলে ঢাকায় কমপক্ষে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন ধসে পড়বে, যা ঢাকার মোট ভবনের ৪০ শতাংশ। ওই মাত্রার ভূমিকম্প দিনে হলে কমপক্ষে ২ লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে। আর রাতে হলে কমপক্ষে ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যাবে।

বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা তখন বিস্ফোরণের শহর হয়ে উঠবে, তা অবধারিত। কারণ, এখানকার পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা এতই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে, বড় মাত্রার ভূমিকম্পে যে বিপর্যয় নেমে আসবে, তা আসলে কল্পনাতীত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বঙ্গবাজার মার্কেটের আগুন, মগবাজারের বিস্ফোরণ, সিদ্দিকবাজারের মার্কেটে বিস্ফোরণ, বেইলি রোডের রেস্তোরাঁ মার্কেটে বিস্ফোরণে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা তো আমরা দেখলামই।

বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড ও সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের পর ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস নিয়ে কথা বলি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। নগরব্যবস্থা, পানি, স্যানিটেশন, পরিবেশ বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উঠে আসে সে সময়ের তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের বিষয়টিও। ২০২৩ সালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে তুরস্কে অর্ধলক্ষাধিক ও সিরিয়ায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মারা যান। সেই ভূমিকম্পের ভয়াবহতা গোটা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘তুরস্ক-সিরিয়ার মতো ভূমিকম্প যদি এখানে ঘটে, কয়েক গুণ মানুষ মারা যেতে পারে। কারণ হচ্ছে, আমাদের ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন হাতে গোনা। অথচ এখানে হাজার হাজার বহুতল ভবন আছে। সেগুলোর কাঠামোগত সামর্থ্য বাড়ানো এখনই সময়। অনেকভাবেই সেটি করা যায়। শুধু ইচ্ছা আর পদক্ষেপটা জরুরি। এখন যে অপরিকল্পিতভাবে নগরগুলো গড়ে উঠছে, সেখানে বড় কোনো ভূমিকম্প ঘটে গেলে, উদ্ধার কার্যক্রম চালানোও তো খুব কঠিন হয়ে যাবে। অনেক সুযোগ-সুবিধাও তো আমাদের নেই। ফলে ভবনের কাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তুরস্কে অনেক ভবন পুরোপুরি ধসে পড়েছে, পাশেই আবার অনেক ভবন দাঁড়িয়ে আছে বা কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার মানে সেগুলো ওই মাত্রার ভূমিকম্প-সহনীয় ছিল। এখন খরচ বাঁচানোর জন্য বা আর্থিক লাভের জন্য ভবনগুলো এভাবে নির্মাণ করা সমীচীন হবে না। এর মাধ্যমে মানুষকে বড় ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। আমরা তো শিল্পোন্নত দেশের দিকে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের শিল্পকারখানাগুলো কী করে? শুধু টাকা বাঁচানোর জন্য বা মুনাফা বেশি করার জন্য ইটিপি চালু রাখা হয় না। এতে মানুষ ও পরিবেশের বিপর্যয় আমরা ডেকে আনছি।’

গুলশানের মতো এলাকায় নতুন ও আধুনিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসকে কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছে। তাদের কাছে ৪০ তলা পর্যন্ত সিঁড়ি থাকলেও সরু রাস্তার হওয়ার কারণে ঠিক সময়ে পৌঁছাতেই পারেনি তারা। এবার ভাবুন তো ঢাকায় বড় কোনো ভূমিকম্পে যখন অনেক ভবন ধসে পড়বে, কীভাবে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো সম্ভব? এই শহরের অলিগলি দিয়ে কীভাবে ঢুকবে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। যে যেভাবে পেরেছে বা পারছে ঢাকা শহরে স্থাপনা গড়ে তুলছেন, কোনো নিয়মের বালাই নেই।

মুজিবুর রহমান সে প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সবকিছুর পেছনে আছে একটাই শব্দ—দুর্নীতি। দুর্নীতির রকমের শেষ নেই। আমরা সেসবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছি। আমরা সেখান থেকে বের হতে পারছি না। আমি মনে করি, এভাবে অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে ওঠা বন্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘাটতি আছে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

কথা হচ্ছে, কবে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা হবে? রাজনৈতিক সদিচ্ছা জাগবে কবে? পরিকল্পিতভাবে রাজধানী ও বড় শহরগুলোকে সাজানোর জন্য এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি আদৌ আছে আমাদের? তাঁরা কথায় কথায় বাংলাদেশকে ‘সিঙ্গাপুর’ বা ‘থাইল্যান্ড’ বানাতে চান। কিন্তু যে ভূমিকম্পে থাইল্যান্ডেই যে অবস্থা দেখা গেল, এমন ভূমিকম্পে ঢাকার কী হবে, তা কি তাঁদের ভাবনায় আছে? ঢাকা আসলে এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়ে আছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে মরে পড়ে থাকা ছাড়া আমাদের বোধ হয় ‘মুক্তি’ নেই।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com