একটা লোক বেলুনে চড়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন। তাঁর যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি ভাসছেন, তবে বেলুনের ওপরে তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি বেশ নিচুতেই নেমে এসেছেন। তবে একেবারে মাটির কাছাকাছিও নন তিনি। মাটি থেকে হাত ত্রিশেক ওপর দিয়ে তিনি ভেসে চলেছেন অজানার দিকে।
ভাসমান লোকটা দেখলেন, নিচে আরেকজন মানুষ কী যেন করছে। বেলুনে চড়া মানুষটি চিৎকার করে উঠলেন, ও ভাই, ও ভাই, আপনি কি জানেন, আমি কোথায়?
নিচের লোকটা ভালো করে তাকিয়ে বলল, আপনি একটা বেলুনে।
না না। বেলুনে যে আমি আছি, এটা তো আমি জানিই। কিন্তু একজাক্টলি আমি আছিটা কোথায়? আমার অবস্থান কী?
নিচের মানুষটা বলল, আপনার অবস্থান মাটি থেকে ঠিক ৪৫ ফিট ওপরে। দ্রাঘিমাংশ...অক্ষাংশ।
বেলুনারোহী বললেন, আপনি নিশ্চয়ই একজন ইঞ্জিনিয়ার?
কেমন করে বুঝলেন?
আপনি যা বলছেন, তা টেকনিক্যালি ঠিক, কিন্তু তা আমার কোনো কাজে লাগছে না।
বেলুনওয়ালা ভেসেই যাচ্ছেন। আরেকজনকে তিনি পেয়ে গেলেন মাটিতে। আবারও চিৎকার করে বেলুনারোহী বললেন, ও ভাই, ও ভাই, আমি ঠিক কোথায়?
নিচের লোকটা বলল, আপনি একটা বেলুনে ভেসে যাচ্ছেন!
তা তো আমি জানি। কিন্তু আমি ঠিক কোথায়?
নিচের লোকটা বলল, আজ সোমবার ১৫ ফেব্রুয়ারি, সেতাবগঞ্জ, বিকেল ৫টা, একজন মানুষ একটা বেলুনে ভেসে যাচ্ছেন এবং তিনি জানেন না তিনি কোথায়। যিনি ভেসে যাচ্ছেন, তাঁকে একজন বছর পঞ্চাশেকের পুরুষ বলেই মনে হচ্ছে। ভাই, আপনি এভাবে ভেসে বেড়াচ্ছেন কেন?
আপনি নিশ্চয়ই একজন সাংবাদিক?
হ্যাঁ। কী করে বুঝলেন?
আপনি ফাইভ ডব্লিউ ওয়ান এইচ দিয়ে কথা বলছেন। কে, কী, কখন, কোথায়, কেন, কীভাবে! আপনি সব বলছেন, কিন্তু আপনার এই কথা আমার কোনো কাজ লাগছে না। আপনি সব বলছেন, কিন্তু কীভাবে আমি রক্ষা পাব, আপনি সেটা বলতে পারছেন না।
উড়ন্ত লোকটা ভেসেই চলেছেন। আরেকজনের দেখা পেলেন তিনি। ভাসমান মানুষটা নিচের মানুষের উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন, ভাই, আমি ঠিক কোথায়?
নিচের লোকটা বলল, ‘আপনি একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে। আপনি ওপরে ভেসে উঠতে পারেন, নিচে নামতে পারেন, আপনি পুবে, পশ্চিমে, উত্তর, দক্ষিণে যেতে পারেন। আপনি গাছের সঙ্গে বাড়ি খেতে পারেন, আবার বিদ্যুতের তারে ধাক্কা খেয়ে মরে যেতে পারেন। আপনার বেলুন ফুটো হয়ে গেলে আপনার মৃত্যুর সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি।
ওপরের ভাসন্ত বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন। আপনি নিশ্চয়ই একজন অর্থনীতিবিদ। আপনি যা বলছেন, সে সবকিছুর সম্ভাবনাই আছে। কিন্তু আমি এই সব প্রবাবিলিটি জেনে কী করব? এর দ্বারা তো আমার নিজের উদ্ধার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে না।
বাতাস এসে বেলুনারোহীকে আরেক জায়গায় নিয়ে গেল। নিচে আরেকজনকে পাওয়া গেল। বেলুনওয়ালা বললেন, ভাই, আমি কোথায়?
নিচের লোক বলল, দেশের ৩০ ভাগ লোক বিশ্বাস করে আপনি আছেন নিরাপদ জায়গায়। ৪৩ ভাগ লোক বিশ্বাস করে আপনার অবস্থা বেশ সঙিন। ৩ ভাগ লোক বিশ্বাস করে আপনার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। ২৮ ভাগ লোক বিশ্বাস করে আপনি যা করছেন, তাতে আপনার কোনো হাত নেই। এটা প্রকৃতির খেয়াল। ৮ ভাগ লোক বিশ্বাস করে এটা একটা যান্ত্রিক ত্রুটি, যা আগে থেকে চেক করে নিলে এড়ানো যেত।
ওপরের ভাসন্ত বললেন, সব ঠিক আছে। তবে আপনি কি সেন্টার ফর নীতি সংলাপে কাজ করেন?
কেন বলছেন?
কারণ, আপনি যা বলছেন, তা হয়তো পরিসংখ্যানের দিক থেকে ঠিক আছে, কিন্তু আপনার এই তথ্য তো আমার কোনো কাজে লাগছে না।
ভাসন্ত লোকটা ভেসেই চলেছেন। নিচে আরেকজনকে পেলেন তিনি। চিৎকার করে বললেন, আমি কোথায়?
নিচের লোক বলল, আরেকটু নিচে আসুন। আমরা এখন লাইভে। এখানে একজন বেলুন-চালককে পাওয়া গেছে। তিনি যথেষ্ট নিচে নেমে এসেছেন। ভাই, আপনার অনুভূতি কী?
আমি জানতে চাচ্ছিলাম, আমি ঠিক কোথায়?
আপনি। আপনি একটা জোস এলাকায়। আপনার হলুদ পোশাকটাতে আপনাকে দারুণ লাগছে। এটা হলো ওয়ানস ইন আ লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স। আপনারা লাইক–শেয়ার করুন। আর আমার চ্যানেলটা সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না।
আপনি নিশ্চয়ই একজন টিকটকার।
না। আমাকে টিকটকার বলবেন না। আমি হলাম ইনফ্লুয়েনশিয়ার।
বেলুনওয়ালা ভেসেই চলেছে। নিচে আরেকজনকে পেলেন তিনি। বললেন, ওই ভাই, আমি কোথায়?
নিচের লোক বলল, আমার কিছু করার নাই, আপনি ফুলবাড়ি আর শটিবাড়ি থানার ঠিক মাঝখানে পড়েছেন। ফলে আপনার দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।
আপনি নিশ্চয়ই একজন পুলিশ।
জি। আমি কালিপুর থানার পুলিশ।
আপনি কি আমার বেলুনটাতে গুলি করে আমাকে নামাতে পারেন?
ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম ছাড়া আমি পারি না। আর আমি গুলি করলে সেটা বেলুনে না লেগে আপনার গায়ে যদি লাগে, তাহলে আমি ক্রসফায়ারের বদনামে পড়ে যাব। সামনে আবার আমার ভিসা ইন্টারভিউ আছে।
বেলুনওয়ালা ভেসেই যাচ্ছেন। আরেকজনকে পেলেন তিনি। বললেন, আপনি কি বলতে পারেন আমি কোথায়?
নিচের জন বললেন, আপনাকে আমার ভীষণ ঈর্ষা হচ্ছে। আমি ভালোবাসি মেঘ...ওই উঁচুতে ওই উঁচুতে...আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল...
আপনি নিশ্চয়ই কবি।
জি কবি।
আপনার কথাগুলো আমার খুব ভালো লাগল। কিন্তু আমার কোনো কাজেই লাগবে না।
এরপর বেলুনওয়ালা একজন ভদ্রমহিলার দেখা পেলেন। বেলুনারোহী বললেন, আমি কোথায়?
তুমি কার ছেলে, বাবা। এই ভরসাঁঝে বেলুনে চড়ে বেড়াচ্ছ। আঁধার হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি নামো। বাড়ি যাও। তোমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তোমার স্ত্রী-সন্তানেরা তোমার কথা ভেবে না খেয়ে আছেন।
আপনি নিশ্চয়ই একজন মা। আপনার কথায় আমার চোখ ভিজে আসছে। কিন্তু আপনার এই কথা তো আমার কোনো কাজে লাগছে না।
এরপর একজন জ্ঞানী ব্যক্তির মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বেলুনটা। বেলুনওয়ালা বললেন, ও সাধু, আমি এখন কোথায়?
সাধু বললেন, তুমি এক মহান অনিশ্চয়তায়। পৃথিবীটা হলো একটা সরাইখানা। আমরা সবাই পথিক। তবে আমাদের দুদিনের এই যাত্রাবিরতিটা ভালো হবে, না মন্দ হবে, তা আমরাই নির্ধারণ করি। প্রকৃতি নিজ থেকে কিছু করে না। কিন্তু কেউ যখন ভালো কিছু করতে চায়, সারাটা পৃথিবী তাকে সাহায্য করার জন্য ষড়যন্ত্র করে।
বেলুনওয়ালা বললেন, আপনি নিশ্চয়ই একজন সাধু। তবে আপনার এই নিত্যতা–অনিত্যতার সূত্র আমার কোনো কাজে লাগছে না।
সাধু বললেন, বাবা, তুমি কে আমি জানি। তুমি হলে সরকারের মন্ত্রী?
কী করে পারলেন?
কারণ, তুমি কোথায় তুমি জানো না। তোমার এই পরিণতির জন্য তুমিই দায়ী। উড়তে হলে তোমার যন্ত্র দিয়েই তোমাকে উড়তে হবে, নামতে হলে তোমার বুদ্ধি দিয়েই তোমাকে নামতে হবে। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তুমি যা ছিলে, আমার সঙ্গে কথা হওয়ার পরেও তুমি তা-ই থাকবে। কিন্তু তুমি তোমার নিজের এই পরিণতির জন্য দায়ী করছ আমাকে। অথচ তুমি আশা করছ, অন্য কেউ তোমাকে সাহায্য করবে। কেউ তোমার সমালোচনা করতে পারবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, তুমি এটা করছ জনগণের টাকায়। আর ভাবছ, এটা করছ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে, জনগণের একজন হয়ে। অথচ জনগণ তোমাকে ঠিক এই কাজ করার জন্য ম্যান্ডেট দেয়নি। তুমি নিজেই নিজেকে এই কাজ করার উপযুক্ত বলে ডিক্লায়ার করেছ।
এরই মধ্যে টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউবের কারণে বেলুনের নিচে অনেক লোক ভিড় করে ফেলল। একজন প্রকাশক চিৎকার করে বললেন, আপনার এই বেলুনভ্রমণ-কাহিনিটা কিন্তু আগামী বছরের বইমেলায় আমরা বই হিসেবে বের করে ফেলছি। চুক্তি ফাইনাল।
বেলুনারোহী বললেন, তা হয়তো করা যাবে। তবে আমি নামব কী করে। আমি এমন জায়গায় চড়েছি, যেখান থেকে নামার রাস্তা আমার জানা নেই।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক