ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সে সময়ের তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কী বলেছিলেন, তা হুবহু দেখে নিই, ‘...মাননীয় স্পিকার, আপনাকে এইটুকু জানাতে চাই, আমাদের আইন অনুসরণ করার জন্য পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো প্রায় প্রতিটি মিটিংয়ের ওপর খোঁজ নিয়েছে যে আপনারা অমুক ধারাতে কী করেছেন, তমুক ধারাতে কী করেছেন? আজকে আমি বলতে পারি যে এই আইন পৃথিবীর অনেক দেশকে অনুসরণ করতে হবে। কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য বিদ্যমান কোনো আইন এখন এক্সিস্ট করে না। ...সিঙ্গাপুরের মতো দেশ, যে দেশটিকে ধনী দেশ বলা হয়, সে দেশটির ডিজিটাল নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিধিবিধান, আইনকানুন—যদি দেখেন—তাহলে প্র্যাকটিক্যাল বুঝতে পারবেন যে আমরা স্বর্গরাজ্য বানিয়েছি, আর ওইটিকে আপনি জেলখানা মনে করতে পারবেন...’ [সূত্র: জাতীয় সংসদ কার্যবিবরণী]।
মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এসে প্রমাণিত হলো, পৃথিবীর কোনো দেশ এই আইন তো অনুসরণ করেইনি, বরং সভ্য সমাজ বলছে, এই আইনের কারণে বাংলাদেশ স্বর্গরাজ্য হয়নি, জেলখানাই হয়েছে।
২০০৬ সালের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহারের জ্বালায় যখন আমরা অতিষ্ঠ, তখন বলা হলো নতুন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ হচ্ছে, এতে ৫৭ ধারার বেদনার উপশম হবে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া দেখে আমরা উৎকণ্ঠিত হলাম, এতে ৫৭ ধারার উপশম তো হলোই না, বরং তা আরও নতুন ব্যথা বাড়াল। আমরা আলোচনায় সক্রিয় হলাম। একেবারে সংসদীয় কমিটিতে পর্যন্ত কথা বললাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে প্রতিশ্রুত বৈঠক শেষ না করেই সংসদে আইনটি পাস করা হলো। সেখানে মন্ত্রী বাহাদুর এ কথা বলেছিলেন যে আমরা (সাংবাদিকেরা) নাকি বিষয়টি বুঝতেই পারিনি।
আমাদের কোনো কথাই শোনা হয়নি। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নানা ধারায় ছড়িয়ে দেওয়া হলো। আখেরে আমাদের কথাই সত্যি হলো। বাংলাদেশকে মন্ত্রীর কল্পিত স্বর্গরাজ্য বানাতে গিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশকে বানাল পচা জেলখানা। পাঁচ বছরে সাত হাজারের বেশি মামলায় হয়রানি হলেন অনেকে, বিনা জামিনে জেলে মারা গেলেন মুশতাক, এখনো জেলে খাদিজাতুল কুবরা।
এখন নানা দেশ ও সংগঠনের যে কথার চাপে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ‘সংশোধন’ করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে, শুরুতে আমরা সে কথাগুলোই বলেছিলাম।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় আমাদের উদ্বেগ ছিল মূলত চারটি জায়গায়—১. জামিন-অযোগ্য ধারা অনেক বেশি, কোথাও শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ অস্বাভাবিক, ২. কোনো কোনো ধারায় অপরাধের সংজ্ঞা অস্পষ্ট, ৩. আইনটিতে পুলিশের যে পর্যায়ে অবারিত ক্ষমতা, তাতে অপপ্রয়োগের মাত্রা বাড়বে, ৪. বিশেষত সংবাদকর্মীদের বেলায় এই আইনের বেপরোয়া প্রয়োগের কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে।
এর সঙ্গে আমরা বলেছিলাম, প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যেসব অপরাধ ও তার সাজার বিধান নিশ্চিত আছে, সেগুলো এই আইনে কেন আনা হচ্ছে? তথ্য অধিকার আইনে আমাদের যে এগিয়ে যাওয়া, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এনে তাকে কেন বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে?
বলাই বাহুল্য, আমাদের এসব কোনো কথাই শোনা হয়নি। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নানা ধারায় ছড়িয়ে দেওয়া হলো। আখেরে আমাদের কথাই সত্যি হলো। বাংলাদেশকে মন্ত্রীর কল্পিত স্বর্গরাজ্য বানাতে গিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশকে বানাল পচা জেলখানা।
পাঁচ বছরে সাত হাজারের বেশি মামলায় হয়রানি হলেন অনেকে, বিনা জামিনে জেলে মারা গেলেন মুশতাক, এখনো জেলে খাদিজাতুল কুবরা। এত মামলার মধ্যে টিকল মাত্র ১৫০টি, আটক হলেন ২৫ জন সাংবাদিক। কাজেই কাউকে হয়রানির জন্য এই আইনের প্রয়োগ স্পষ্ট।
নতুন ও প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া দেখছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তুলনায় কিছু ধারায় জামিনের সুযোগ বাড়াল বটে, কিন্তু কিছু ধারায় অস্বাভাবিক জরিমানার বিধান করা হলো। সেই জরিমানা দিতে না পারলে জেলে যাওয়ার খড়্গ মাথার ওপর ঝুলেই থাকল। আইনমন্ত্রী বলছেন, ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও বিচারক ১ টাকাও জরিমানা করতে পারেন। কথা সত্য, তাহলে বিশাল অঙ্কের জরিমানা রাখা হলো কেন? ভয় দেখানোর জন্য?
বাকি ধারাগুলোতেও খুব বড় পরিবর্তন দেখছি না। তুলনামূলক আলোচনা না করে প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি আইনটি ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আনতে কয়েকটি সুপারিশ করতে চাই।
১. ফৌজদারি আইনে যেসব অপরাধ ও সাজা নির্ধারণ করা আছে, এই আইনে তা সংযোজন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ২. এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করে ১০০ বছরের পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে নতুন করে জীবন দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
৩. আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারায় অপরাধের সংজ্ঞা ও এই আইনের প্রয়োগের প্রক্রিয়া আরও সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। ৪. খসড়ায় ৪৩ ধারা সাব-ইন্সপেক্টরের ‘নিচে নহেন’, এমন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের’ ক্ষমতা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই রাখা হয়েছে।
এটিই হচ্ছে আইনটির ‘মিস ইউজ ও অ্যাবিউজ’-এর মূল শক্তি। এই ধারা অক্ষুণ্ন রেখে আইন অপব্যবহার হবে না—বিষয়টি কোনোভাবেই নিশ্চিত করা যাবে না। সংবাদকর্মীরাও এর খপ্পরে আগে যেমন পড়েছেন, এবারও রেহাই মিলবে না। আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব, কোনোভাবেই এই ধারায় সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীকে পেশাগত কোনো কাজের জন্য গ্রেপ্তার করা যাবে না। সাংবাদিকের কোনো কাজে আপত্তি থাকলে সমন জারি করে আদালতে হাজির হতে বলা যাবে। আবারও পুরোনো প্রস্তাব তুলে ধরি—সাংবাদিকের নামে কোনো মামলা করার গ্রহণযোগ্যতা (প্রাইমা ফেসি) যাচাইয়ের জন্য প্রেস কাউন্সিলের মতামত নিতে হবে।
খসড়া আইনের কোনো ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সংবিধানের বিধান, তথ্য অধিকার আইন-২০১৯ ও জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় কি না, তা আরও নিবিড়ভাবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘মিস ইউজ ও অ্যাবিউজ’ হয়েছে, এটা আইনমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। অনেককে শুধু হয়রানি করার জন্যই মামলা করা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইন যাতে সেই একই পথে না হাঁটে, সে জন্য এই আইনে এমন একটি ধারা সংযোজন করতে বলছি, যাতে কেউ মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা করলে তাঁর (বাদীর) বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। খসড়া আইনে ‘জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি’ গঠনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে একজন সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম বিশেষজ্ঞ রাখার প্রস্তাব রাখছি। এতে আইনটি প্রয়োগের শুরুতেই অনেক ঝামেলা এড়ানো যাবে।
শেষ করার আগে আবারও বলি, পৃথিবী পাল্টাচ্ছে, অপরাধের ধরনও বদলাচ্ছে। সাইবার জগৎ যেমন আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার অবারিত দুয়ার, তেমনি এই জগৎ অপরাধীদের জন্যও উন্মুক্ত করেছে অপরাধের নানা ক্ষেত্র ও কৌশল। কাজেই সাইবার জগৎ থেকে চোখ মুদে থাকার কোনো অবকাশ নেই।
ইউরোপ-আমেরিকার প্রায় সব দেশেই নানা নামে সাইবার নিরাপত্তা আইন আছে। এসবে সাজাও বেশ কঠিন। আমেরিকার নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বলেন, আওয়ার নেশন ইজ এট রিস্ক, সিকিউরিটি স্টার্টস উইথ সাইবার। সে জন্য তাদের এ বিষয়ে একেবারে যে প্রাথমিক আইন, তা হচ্ছে ফেডারেল ট্রেড কমিশন অ্যাক্ট(এফটিসিএ)। ব্রিটেনে অনেক আগেই প্রাথমিক যে আইন করা হয়েছে, তা হচ্ছে, দ্যা কম্পিউটার মিসইউজ অ্যাক্ট ১৯৯০।
বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তায় আইন করা সময়ের দাবি। খেয়াল রাখতে হবে, সেই আইন দেশকে স্বর্গরাজ্য না বানাক, জেলখানা যাতে না বানায়।
কিন্তু আইসিটি থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উত্তরণে চুন খেয়ে মুখ পুড়িয়েছি, এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনের কথা শুনে দই খেতে ভয় পাচ্ছি। খসড়া দেখে সে আশঙ্কা আরও দৃঢ় হলো।
অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করাই এই সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ।
মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিক, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি