ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধের পুরোটা সময় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) উল্লেখ করার মতো নিশ্চুপ অবস্থায় রয়েছে। ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে যে হামলা চালানো হয়েছে সেটার অংশ ছিল না ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। এর কারণ অবশ্য বোধগম্য, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সশস্ত্র প্রতিরোধী গোষ্ঠী নয়।
দ্য প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (পিএলএ) গঠিত হয়েছিল একটা জাতীয় অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপরেখার আওতায় এবং প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের আমলে পিএলএ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সহায়ক সংস্থার চেয়েও কম মর্যাদাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবুও সশস্ত্র প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেওয়া ও নিষ্ক্রিয় অবস্থান নেওয়া (ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এখন যে অবস্থান নিয়েছে)—এই দুইয়ের বাইরে গিয়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের আরও অনেক বড় কিছু করার ছিল।
৭ অক্টোবরের ঘটনাপ্রবাহ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে বিস্মিত করেছে। সবাই বুঝতে পেরেছিল যে এই হামলায় ইসরায়েল যে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে চলেছে সেটা আগে কখনো দেখা যায়নি।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই ধারণা করেছিল যে এর পরিণতিতে সামরিক শক্তি হিসেবে অথবা গাজার শাসক হিসেবে হামাসের ক্ষমতা স্থায়ীভাবে শেষ হয়ে যাবে। এই বোঝাপড়া থেকেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এমন নেতিবাচক নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। সে কারণে পরিণতি দেখার জন্য ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করেছে যাতে করে গাজার নিয়ন্ত্রণ তারা নিতে পারে। সেই সঙ্গে গাজা পুনর্গঠনের জন্য বিশাল অঙ্কের যে সহযোগিতা আসবে, তার নিয়ন্ত্রণ যেন তারা করতে পারে।
এই অবস্থানের কারণে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ প্রায় নীরব ও চলমান পরিস্থিতিকে পরোক্ষভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। মাহমুদ আব্বাস হামাসকে নিন্দা করেছে। যুক্তরাজ্য ও আরও কিছু দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে। গাজায় ইসরায়েলে হামলায় সুযোগ করে দিয়েছে এই অভিযোগে তিনি হামাসকে দোষারোপ করেছেন।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আসলে কী করল? শেষ পর্যন্ত তারা কিছুই করল না। ইসরায়েলি যুদ্ধযন্ত্রকে তারা সেটাই করতে দিল, যেটা তারা নিজেরা করতে পারেনি।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কি অন্য কোনো অবস্থান নিতে পারত? সব সময়ই অন্য বিকল্প তাদের সামনে ছিল। এই ঘটনার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে পারত, সেখানে হামাসকে বিচ্ছিন্ন করার কিংবা তাদের দানবীয় শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা না করে স্বাগত জানানো যেত।
সত্যি যে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি, কিন্তু যুদ্ধ অবসানের জন্য তাদের যে আহ্বান, সেটা অনেকাংশে উপশমমূলক ও আত্মপ্রচারমূলক। এ থেকে নীতিগত কোনো পদক্ষেপ আসেনি। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিজেদের জর্ডান, মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই অক্ষের সঙ্গে নিজেদের মৈত্রী খুঁজে পেয়েছে। বিশেষ করে গাজায় হামাসের শাসন অবসানের জন্য এই পক্ষটি যুদ্ধকে প্রয়োজনীয় মন্দ বলে মনে করে।
এমন একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যে পক্ষপাতমূলক অবস্থান নিয়েছে, তাতে করে তাদের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা খর্ব হয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি ওয়াশিংটন যেভাবে নগ্নভাবে বৈরিতা প্রদর্শন করছে, সেই প্রেক্ষাপট যদি বিবেচনায় নেওয়া যায়।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রকৃতপক্ষে গাজা যুদ্ধ শুরুর আগে জর্ডান,মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই অক্ষেই ছিল। কিন্তু রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেওয়ার কিছু বুদ্ধিমান কৌশল বের করে। যাহোক, এই কৌশল দিয়ে তারা বড় কোনো চাপ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কি অন্য কোনো অবস্থান নিতে পারত? সব সময়ই অন্য বিকল্প তাদের সামনে ছিল। এই ঘটনার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে পারত, সেখানে হামাসকে বিচ্ছিন্ন করার কিংবা তাদের দানবীয় শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা না করে স্বাগত জানানো যেত।
ফিলিস্তিনের ও আঞ্চলিক কয়েক গোষ্ঠী এমন পরামর্শই দিয়েছিল। কিন্তু ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গাজা থেকে হামাসের শাসন অবসানের জন্য সেসব পরামর্শ খারিজ করে দিয়েছে।
সেটা ছিল একটা মহা ভুল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর অতি ডানপন্থী সরকার, যারা হামাসের নির্মূল চায়, তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকেও বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করবে না। কারণ তারা মনে করে, পশ্চিম তীর ও গাজা—দুই স্থানেই ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মানে হলো, তাদের শাসনের প্রতি রাজনৈতিক হুমকি তৈরি হওয়া। ফিলিস্তিনিদের একটা ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব থাকার আরেক অর্থ হচ্ছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় একটা পদক্ষেপ।
এ ছাড়া ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গাজার নির্বাচনগুলো এড়িয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা বাইরের শক্তিগুলোকে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুরুপের তাস তুলে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মার্কিন অবস্থানে কয়েদ হয়ে গেছে, যেটা প্রকারান্তরে ইসরায়েলি অবস্থান।
প্রায় আট মাসের গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের লক্ষ্যগুলো বারবার ব্যর্থ হয়েছে, যদি না তাদের লক্ষ্য হয় গাজার হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা। এর আগে হামাস যেভাবে গাজা শাসন করেছে, সেই অবস্থায় তারা ফিরে আসতে না-ও পারে, কিন্তু পরে যে ঘটনা আসুক না কেন, সেটা ফয়সালার ক্ষেত্রে তারা শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে।
আউনি আলমাশনি ফাতাহ আন্দোলনের পরামর্শক পরিষদের সদস্য
মিউল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত