বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জরুরি চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাকে (ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিসেস—ইএমএসএস) যেকোনো দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। এটি এমন একটি কাঠামো, যা থেকে আহত কিংবা স্বাস্থ্য সংকটগ্রস্ত ব্যক্তিকে নিরাপদে হাসপাতালে পৌঁছানো পর্যন্ত জীবন রক্ষাকারী সব ধরনের চিকিৎসাসেবা প্রদান করে। একজন ব্যক্তি যখন দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সংকটে পড়েন, জীবন বাঁচানোর জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি ‘কার্যকর ইএমএসএস’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইএমএসএসের মধ্যে আহত কিংবা স্বাস্থ্য সংকটগ্রস্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার এবং জরুরি ভিত্তিতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং তাকে নির্দিষ্ট হাসপাতালে পৌঁছানো পর্যন্ত নিরাপদ পরিবহন অন্তর্ভুক্ত। এটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জরুরি সেবা, যেমন পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় করতে হয়। এসব ব্যবস্থার লক্ষ্য থাকে আহত ব্যক্তির জীবন রক্ষা, আঘাতের তীব্রতা হ্রাস এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি করা। ইএমএসএস শুধু হাসপাতালের চিকিৎসকদের ওপর নির্ভর করে না, এটি মূলত সারা দেশের একটি বৃহত্তর সেবাকাঠামো, যেখানে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক, নার্স এবং জরুরি চিকিৎসাবিশেষজ্ঞরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন।
বাংলাদেশে জরুরি বিভাগের চিকিৎসাপ্রার্থীর সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ, এখানে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। বেশির ভাগ চিকিৎসাপ্রার্থী হাসপাতালে আসার পর তাদের বহির্বিভাগ, অভ্যন্তরীণ বিভাগ, জরুরি বিভাগ এবং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এ ছাড়া দেশটিতে এখনো পর্যন্ত জরুরি সেবা এবং এর পরিবহনব্যবস্থাকে স্বাস্থ্য খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে জরুরি অবস্থায় চিকিৎসা পেতে অনেকেই কষ্টের সম্মুখীন হন এবং তাতে প্রায়ই অধিক হারে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে।
উন্নত এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত ইএমএসএস একটি স্থিতিশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গঠনে, আঘাতের তীব্রতা হ্রাসে এবং মৃত্যুহার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেখানে স্বাস্থ্য খাতের সম্পদ সীমিত এবং অনেক ক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসাসেবা পাওয়া বেশ কঠিন। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবায় এমন অনেক ঘাটতি রয়েছে, যা একটি সঠিক এবং কার্যকর এমএসএসের মতো ব্যবস্থাকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে সড়ক এবং আকস্মিক স্বাস্থ্য সংকটজনিত দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে, সেখানে ইএমএসএসের ভূমিকা অপরিহার্য।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জরুরি বিভাগের চিকিৎসাপ্রার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৭ সালে প্রতি ১০০০ জনে ৩৫৩ জন জরুরি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ৪১১ জনে পৌঁছায়, যা মোট প্রায় ১৩১ মিলিয়ন চিকিৎসাপ্রার্থীকে জরুরি সেবা প্রদান করার সমান। এই বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দ্বিগুণ। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে ২০২২ সালে যেখানে ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষ জরুরি সেবা গ্রহণ করেছিল, ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১ দশমিক শূন্য মিলিয়ন।
বাংলাদেশে জরুরি বিভাগের চিকিৎসাপ্রার্থীর সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ, এখানে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। বেশির ভাগ চিকিৎসাপ্রার্থী হাসপাতালে আসার পর তাদের বহির্বিভাগ, অভ্যন্তরীণ বিভাগ, জরুরি বিভাগ এবং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এ ছাড়া দেশটিতে এখনো পর্যন্ত জরুরি সেবা এবং এর পরিবহনব্যবস্থাকে স্বাস্থ্য খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে জরুরি অবস্থায় চিকিৎসা পেতে অনেকেই কষ্টের সম্মুখীন হন এবং তাতে প্রায়ই অধিক হারে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে।
বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী এবং সঠিকভাবে পরিচালিত ইএমএসএস ব্যবস্থা থাকলে দুর্ঘটনা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সংকটগ্রস্ত অবস্থায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হবে, যার ফলে অঙ্গহানি, বিকলাঙ্গতা এবং অকালমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের প্রথম দিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পতিত হাসিনা সরকারের দমনপীড়নকে উল্লেখ করা যেতে পারে। কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের ওপর সরকারের সহিংস দমন অভিযানে হাজার হাজার ছাত্র আহত হন এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। ইএমএসএস ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের ঘটনা থেকে অনেক প্রাণ বাঁচানো যেত এবং অনেক আহত ব্যক্তিকে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতো।
গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতার অবনতি। এর প্রভাব স্বাস্থ্য খাতেও পড়েছে। দুর্নীতি, অপদার্থ নেতৃত্ব এবং রাজনীতিকরণের ফলে জরুরি সেবাব্যবস্থায় আরও বেশি বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। জরুরি চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে অনেক মানুষ আর্থিক সংকটে পড়ছে, যা তাদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনছে।
বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো সীমিত প্রবেশাধিকার, দুর্বল অবকাঠামো, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব এবং আকাশচুম্বী চিকিৎসা ব্যয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট আঘাতের ক্রমবর্ধমান হার, যা এখন সংক্রামক রোগের চেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। বর্তমানে তথ্য অনুসারে মোট মৃত্যুর প্রায় ১২ শতাংশ দুর্ঘটনাজনিত আঘাতে ঘটে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি দেশের প্রধান মৃত্যুর কারণগুলোর একটি হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যে একটি কার্যকর ইএমএসএস ব্যবস্থা গড়ে তুললে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পৌঁছানোর সময় অনেক কমে যাবে। এ ছাড়া পরিবহনকালে আঘাতের ঝুঁকি কমবে এবং প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া এটি জরুরি প্রস্তুতি এবং হাসপাতালের সঙ্গে সমন্বয় আরও উন্নত করবে এবং সর্বোপরি দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবে।
ইএমএসএসের উন্নয়নে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উচ্চমাত্রার মনোযোগ, একটি আইনি কাঠামো, স্বাস্থ্য নীতিমালা সংস্কার, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া সরকারি–বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ৯১১ জরুরি সেবাব্যবস্থা একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে। ১৯৬৭ সালে এটি অ্যান্ড টি এবং ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনের যৌথ উদ্যোগে ৯১১ নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের সমর্থন লাভ করে। ধীরে ধীরে ৯১১ নম্বর পুরো যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক জরুরি সেবা নম্বরে পরিণত হয়।
বাংলাদেশও এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে জরুরি সেবা অর্থাৎ ইএমএসএসকে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একীভূত করতে পারে। এর মাধ্যমে একটি বিস্তৃত এবং শক্তিশালী জরুরি সেবাকাঠামো তৈরি করা সম্ভব হবে, যা জনসাধারণের সঠিক ও দ্রুত চিকিৎসাপ্রাপ্তিতে সহায়ক হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে চলমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে ইএমএসএসের আশু প্রবর্তন একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে। একটি কার্যকর ইএমএসএস বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করতে পারে। এটি শুধু দুর্ঘটনাজনিত আঘাতের পরিণতি কমাবে না, বরং এটি দেশের স্বাস্থ্য খাতকে আরও সমন্বিত, সুশৃঙ্খল এবং শক্তিশালী করবে।
ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার সাবেক গবেষণা পরিচালক, ব্র্যাক এবং অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো ও ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইনস