বিশ্বাস করুন আর না–ই করুন, ইউক্রেন থেকে ভালো কিছু খবর জন্ম হচ্ছে।
জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মতামত জরিপে থেকে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউক্রেনীয় চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শান্তি আলোচনা যেন শুরু করা হয়।
কমবেশি ৫২ শতাংশ মানুষ রাশিয়ার সঙ্গে পুরোপুরি সামরিক বিজয় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নটি খারিজ করে দিয়েছেন। অথচ ভলোদিমির জেলেনস্কি ও পশ্চিমা সরকারগুলোর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নীতির ভিত্তি হলো এই ধারণাটি।
এটা নিশ্চিত করেই দুই বছর আগের অবস্থান থেকে উল্লেখ করার মতো পরিবর্তন। সে সময়ে ইউক্রেনের মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ শান্তি আলোচনা ধারণায় সমর্থন জানিয়েছিলেন।
গত দুই সপ্তাহে আমরা দেখেছি, রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই দিক থেকেই বিপজ্জনকভাবে সামরিক উত্তেজনা বাড়ানো হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি মাঝারি পাল্লার মিসাইল দিয়ে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে হামলার অনুমতি দিয়েছে। যুক্তরাজ্যও তাদের স্ট্রম শ্যাডো মিসাইল ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
জেলেনস্কিও সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সেনাদের সেই মিসাইল ছোড়ার আদেশ দেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়েছেন। গত সপ্তাহে তিনি ঘোষণা দেন যে ইউক্রেনকে যেসব দেশ অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে, সেসব দেশে হামলা করার অধিকার আছে রাশিয়ার। সরাসরি তিনি হুমকি দেন যে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
নিজের বলা কথা যে মিথ্যা নয়, সেটা প্রমাণের জন্য পুতিন ইউক্রেনে আন্তমহাদেশীয় মিসাইল ছোড়েন, যেটা পারমাণবিক ওয়্যারহেড বহনে সক্ষম।
শুধু আকাশে নয়, মাটিতেও উত্তেজনা ছড়াচ্ছে নানাভাবে। উত্তর কোরিয়া থেকে ১০ হাজার ভাড়াটে সেনা রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে গেছেন। গত সপ্তাহে বাল্টিক দেশগুলো ও ন্যাটোর উত্তরাঞ্চলের দেশগুলোর মন্ত্রীরা ইউক্রেনে সেনা পাঠাবেন কি না, এ–সংক্রান্ত একটা সভায় মিলিত হয়েছিলেন।
এই পিচ্ছিল বাস্তবতা রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরিতে এক ধাপ অগ্রগতি।
সাইপ্রাস মডেল
বিপর্যয় ঠেকাতে পারে, এ রকম যেকোনো কিছুকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে। সে ক্ষেত্রে গ্যালাপের জরিপের ফলাফল আশাবাদ তৈরি করে।
অন্য জরিপের ফলাফলও প্রায় একই। কিন্তু শান্তিচুক্তিটা কেমন হতে পারে? গ্যালাপ জরিপে অংশ নেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউক্রেনীয় মনে করেন, রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে ইউক্রেনকে তার পূর্বাঞ্চলের ভূমি ছেড়ে দেওয়া উচিত।
এর জন্য দনবাস ও ক্রিমিয়ার ওপর ইউক্রেনকে তার আইনগত সার্বভৌমত্ব পরিত্যাগ করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে যে ওই অঞ্চলগুলোর ওপর তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
এটা অনেকটা সাইপ্রাস মডেলের মতো একটা মডেল হতে পারে। তুরস্কের (ঘটনাক্রমে ন্যাটো সদস্য) সাইপ্রাস আক্রমণের ৫০ বছর পেরিয়েছে। তুরস্ক দেশটির ৩৭ শতাংশ ভূখণ্ড দখলে নিয়েছিল। গ্রিক সাইপ্রাসের কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন। পালিয়ে গিয়েছিলেন আরও কয়েক হাজার।
পরবর্তীকালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দুই অঞ্চলের জনসংখ্যা অদলবদলের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তুর্কিরা দ্বীপের দক্ষিণ অংশ ছেড়ে যায়। আর গ্রিকরা ছেড়ে যায় উত্তর অংশ। উত্তরাংশে তুরস্ক একটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে এখন পর্যন্ত তাদের ৪০ হাজার সেনা রয়েছে। যদিও বিশ্বের একটি দেশও এর স্বীকৃতি দেয়নি।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন নিরপেক্ষ অঞ্চলটিতে টহল দেয় এবং যুদ্ধবিরতি রেখা তদারকি করে।
সেপ্টেম্বর মাসে শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স এবং মস্কোভিত্তিক লেভাদা অ্যানালিটিক্যাল সেন্টার পরিচালিত জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশ রাশিয়ান মনে করেন, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার শান্তিচুক্তির খসড়া হাতে না থাকা রাশিয়ার জন্য বড় হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই পশ্চিমা কয়েকজন বিশ্লেষক একটি শান্তিচুক্তির জন্য রাশিয়ার কাছে কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে তাঁদেরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, তাঁদের মতামতকে জায়গা দেওয়া হয়নি। যাঁরা যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনার পক্ষে কথা বলেছেন, তাঁদেরকেই ‘পুতিনপন্থী’ বলে আক্রমণ করা হয়েছে।
ইউক্রেনীয়দের মতামত এই অভিযোগের দুর্বলতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। ৫২ শতাংশ ইউক্রেনীয় আর ‘পুতিনপন্থী’ হতে পারেন না।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে জেলেনস্কির যুদ্ধ বিজয়ের স্বপ্নের সমালোচনা তাঁরা করেছেন বাস্তববাদের ওপর ভিত্তি করে। যুদ্ধের প্রথম দিকে সবাই, বিশেষ করে পুতিন ইউক্রেনীয়দের সাহস ও সংকল্প দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। কেননা রাশিয়ার ট্যাংকবহরকে তারা প্রতিহত করে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই সংঘাত ‘পরিখার যুদ্ধে’ পরিণত হয়। রাশিয়ার সামরিক শক্তি বেশি হওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই তারা প্রভাব বিস্তার করছে।
জমাট বেঁধে যাওয়া সংঘাত
যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে তাতে পুতিন পরাজিত হবেন না। এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকা মানে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় সেনার মৃত্যু। এর মানে হচ্ছে, ড্রোন, মিসাইল, বোমা আর গোলায় ইউক্রেনীয় শহরগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া। লাখ লাখ ইউক্রেনীয়ও শরণার্থীর জীবন আরও দীর্ঘতর হওয়া।
পশ্চিমা সাংবাদিকেরা ইউক্রেনীয়দের সাহস ও সংকল্পের প্রশংসা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছেন। তাঁরা ইউক্রেনীয় মনোবল চাঙা রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু যেসব ইউক্রেনীয় শান্তি আলোচনার পক্ষে, খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁদের সাক্ষাৎকার তাঁরা নেন।
কিন্তু মিডিয়ার এই সেলফ–সেন্সরশিপ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শান্তি আলোচনা কীভাবে শুরু করা যাবে?
ইউক্রেনের আত্মসমর্পণ ছাড়া পুতিন কোনো যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে আগ্রহী নন। তাঁর সেনারা দনবাস অঞ্চলে ভূমি দখল অব্যাহত রেখেছে। তিনি তাদেরকে থামাতে আগ্রহী নন। ইউক্রেন রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। রাশিয়ার সেনারা সেই যুদ্ধক্ষেত্রেও ইউক্রেনীয়দের কাঁবু করে ফেলছে।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এক দিনেই যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন। তাঁর অভিষেক হতে এখনো দুই মাস বাকি।
জানুয়ারি মাসে তিনি যদি জেলেনস্কি, ন্যাটো নেতাদের এবং পুতিনকে যুদ্ধবিরতি আর শান্তি আলোচনায় বসাতে পারেন, তাহলে তিনিই তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধ বন্ধের সত্যিকার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন।
ইউক্রেনের মতো রাশিয়াতেও এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হবে। কেননা রাশিয়া পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফলও বলছে, দেশটিতেও শান্তি আলোচনা শুরু করার পক্ষে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
সেপ্টেম্বর মাসে শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স এবং মস্কোভিত্তিক লেভাদা অ্যানালিটিক্যাল সেন্টার পরিচালিত জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশ রাশিয়ান মনে করেন, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার শান্তিচুক্তির খসড়া হাতে না থাকা রাশিয়ার জন্য বড় হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
৫৪ শতাংশের একটু বেশি মানুষ মনে করেন, সামরিক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার চেয়ে শান্তি আলোচনা শুরু করার সময় এসেছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। পশ্চিমা সরকারগুলোকে অবশ্যই সেটা সমর্থন দেওয়া জরুরি।
জোনাথন স্টিল, প্রবীণ সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে লেখালেখি করেন। ১৯৭০–এর দশকে দ্য গার্ডিয়ান–এর ওয়াশিংটন ব্যুরোর প্রধান ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের সময় দ্য গার্ডিয়ান–এর মস্কোর ব্যুরো প্রধান ছিলেন।
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত