কানাডার প্রধান নগরী টরন্টো এখন স্বাভাবিকভাবেই কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের সবচেয়ে প্রিয় আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। ধারণা করা হয় যে টরন্টোয় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ইতিমধ্যে পাঁচ লাখ অতিক্রম করেছে।
টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’ সাধারণ বাংলাদেশি জনগণের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা অর্থে গড়ে তোলা প্রাসাদসম বাড়ির একটি পাড়া হিসেবে। অনেকেই শুনে অবাক হবেন, বেগমপাড়া বলে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থান টরন্টো বা তার আশপাশের শহরগুলোর কোথাও নেই। এই ‘বেগমপাড়া’ শব্দটি নেওয়া হয়েছে একজন ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতার একটি চলচ্চিত্র বেগমপুরা থেকে।
ভারতের ওই চলচ্চিত্র নির্মাতা সাড়াজাগানো ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ভারতীয় ক্রমবর্ধমানসংখ্যক পেশাজীবীদের বিনিয়োগের ওপর আলোকপাতের জন্য। এসব উচ্চ বেতনের পেশাজীবী মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত থাকলেও তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসের জন্য নিতে আগ্রহী ছিলেন না।
তাই সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করে তাঁরা কানাডার অভিবাসন নিয়ে টরন্টোর বিভিন্ন স্থানে এবং এর আশপাশের শহরগুলোয় বাড়িঘর কিনে স্ত্রী ও সন্তানদের আবাসস্থল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে। এভাবে গড়ে উঠেছিল ‘বেগমপুরা’গুলো, যেখানে পুরুষ অভিভাবকের পরিবর্তে নারী অভিভাবকেরাই সন্তানদের নিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন।
সন্তানদের উন্নত দেশের পরিবেশে বড় করে তোলা এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার তাগিদে এসব নারী বছরের বেশির ভাগ সময় স্বামীর সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে একাকী বসবাস করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। বছরে বড়জোর একবার কিংবা দুবার এসব নারী ও তাঁদের সন্তানেরা তাঁদের স্বামী ও বাবার সাহচর্য পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতেন, বাকি সময়টা সন্তানদের জীবন কাটে মায়ের অভিভাবকত্বে।
এভাবে খণ্ডিত পরিবারের জীবনযাত্রা নিশ্চয়ই বঞ্চনা ও বেদনাভারাক্রান্তই হওয়ার কথা। তাঁদের এহেন বঞ্চনা, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতাকে হাইলাইট করার জন্যই বেগমপুরা ফিল্মটি নির্মিত হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি ভারতে ও কানাডায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। দর্শকদের মধ্যে এসব নারী ও তাঁদের সন্তানদের প্রতি সমবেদনাই উথলে ওঠে চলচ্চিত্রটি দেখার পর।
কিন্তু বাংলাদেশিদের গড়ে তোলা বেগমপাড়ার বৈশিষ্ট্য আলাদা। টরন্টো নগরীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় এবং টরন্টোর আশপাশের ছোট ছোট শহর মিসিসওগা, হ্যামিল্টন, গুয়েল্ফ ও অন্টারিও লেকের পাড়ঘেঁষা উপশহরগুলোর প্রাসাদসম অট্টালিকা বা ‘লেকশোর অ্যাপার্টমেন্ট’ ক্রয় করে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বেগমপাড়া। কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকার নাম বেগমপাড়া নয়, টরন্টো নগরীর আওতাভুক্তও নয় এসব বাড়িঘরের বেশির ভাগের অবস্থান। এসব বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট সাধারণ কানাডীয় নাগরিক কিংবা কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় থাকা বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট নয়। এগুলোর দাম প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার (১০ কোটি টাকার সমমূল্যের) থেকে শুরু করে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন ডলার (২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার সমমূল্যের) হয়ে থাকে।
কানাডায় বসবাসকারী ও কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসীরা সাধারণত কানাডার মর্টগেজ সিস্টেমের সুবিধা নিয়ে ৩ লাখ ডলার থেকে ৬ লাখ ডলার দামের বাড়ি সহজেই কিনতে পারেন। এ জন্য যেসব শর্ত পালন করতে হয়, সেগুলো বেশ সহজ, বিশেষত স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরিজীবী হলে ভাড়াবাড়িতে বা অ্যাপার্টমেন্টে থাকার জন্য যে মাসিক ভাড়া গুনতে হয়, তার চেয়েও সহজ শর্তে এবং কম মাসিক মর্টগেজ-কিস্তিতে কানাডায় বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা সম্ভব। তাই বেশির ভাগ বাংলাদেশি অভিবাসী যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট কেনাকেই অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ব্যবস্থা বিবেচনা করে থাকেন।
কানাডায় অভিবাসী বাংলাদেশিরা এসব বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের মালিক নন। তাঁরা বেগমপাড়ার ধনাঢ্য বাসিন্দা নন। সাধারণ এই বাংলাদেশি অভিবাসীরা বরং বেগমপাড়াকে ঘৃণা করে থাকেন। কারণ, পুঁজি পাচারকারী ধনাঢ্য বাংলাদেশিরা টরন্টোর রিয়েল এস্টেটের বাজারে অসহনীয় মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী। এসব ধনাঢ্য মালিক সরাসরি নগদ অর্থে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকেন, তাঁরা মর্টগেজ সিস্টেমের সহায়তা নেন না। এক দশকে টরন্টো নগরী এবং আশপাশের শহরগুলোয় বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে বেগমপাড়ার মালিকদের অর্থের তাণ্ডবে।
বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্যের প্রচলিত পুঁজি পাচারের হাতিয়ার ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে পুঁজি পাচারের প্রধান হাতিয়ার আন্ডারইনভয়েসিং। এই পাচারকৃত অর্থের মাধ্যমে বেগমপাড়ায় বাড়ি কেনা হয়। তা ছাড়া রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে বাড়িঘর কেনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক কালে হুন্ডি-পদ্ধতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্সের অর্থ (বৈদেশিক মুদ্রা) হুন্ডিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে যাঁরা বিদেশে পুঁজি পাচারের সক্ষমতা রাখেন, তাঁরাও কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকেন। সে জন্য বেগমপাড়া হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিদেশে ‘অবৈধ স্বর্গ’ বানানোর প্রতীক। বেগমপাড়ার বেগম সাহেবাদের জন্য কারও কোনো সমবেদনা জাগে না। কারণ, তাঁরা স্বেচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অর্থ পাচারের সক্রিয় সহযোগী হিসেবে।
বিশ্বের নানা দেশে প্রায় ১ কোটি ৪৯ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করছেন বলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। তাই প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা আনুমানিক দেড় কোটি ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাঁদের কতজন কর্মরত রয়েছেন, সেটা জানা খুবই কঠিন। তাঁদের মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ ‘সপরিবার অভিবাসী’ হিসেবে বিদেশে বসবাস করছেন, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে এবং মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন বলে ধারণা করা হয়।
‘পুঁজি পাচার’ নিয়ে আমার অনুসন্ধান ও গবেষণায় এই আনুমানিক দেড় কোটি বাংলাদেশি অভিবাসীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশকেই আমি যুক্ত করতে পেরেছি। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, পোশাক কারখানার মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাঁদের অবস্থান।
অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তাঁরা দেশ থেকে বিদেশে অভিবাসী হতে বাধ্য হচ্ছেন—এমন বলা যাবে না। ‘এলিট’ গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান সত্ত্বেও আরও বেশি সুখ-শান্তির আশায় তাঁরা দেশত্যাগে উদ্যোগী হচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁরা ‘কালোটাকার মালিক’, ভালো মানের শহুরে সম্পত্তির মালিক কিংবা শিল্পকারখানা-ব্যবসায়ের মালিক হওয়ায় তাঁরা দেশের ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
সংবাদপত্রের কলামগুলোয় আমি নিয়মিতই তাদের ‘জাতির এক নম্বর দুশমন’ আখ্যায়িত করে চলেছি। তাঁরা যদি নিজেদের বাপ-দাদার সূত্রে প্রাপ্ত এ দেশের সম্পদ বিক্রি করে বিদেশি নাগরিকত্বের আশায় অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় শামিল হন, তাহলে তাঁদের ‘জাতির দুশমন’ আখ্যায়িত করা যৌক্তিক হতো না। অথবা নিজেদের সারা জীবনের বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয় থেকে উদ্ভূত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সূত্রে প্রাপ্ত অর্থসম্পদ বা সম্পত্তি বিক্রয় করে যদি কেউ অভিবাসনের মাধ্যমে পরবর্তী সময় বিদেশে সপরিবার বসবাসের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেন, তাঁকেও গালমন্দ করা ঠিক হবে না।
কিন্তু আমার গবেষণার সূত্রে আমি যাঁদের ‘জাতীয় দুশমন’ অভিহিত করছি, তাঁরা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তাঁরা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী।
তাঁরা ৫২ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে তাঁদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ফ্রেটারনিটি এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন।
● ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক