সুষ্ঠু নির্বাচনের একটা মৌলিক মাপকাঠি হলো ‘ঝুঁকি’ থাকা। মানে সেই নির্বাচনে কে জিতবে, তা নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা। ধরুন বৈধ কোনো জরিপ দেখাচ্ছে যে একটি দল ব্যাপক ভোটে জিতবে। তখনো কিন্তু একটা অনিশ্চয়তা থাকা উচিত। যেমন ভোটের দিনে সেই দলের সমর্থকেরা ভোট দিতে বের হবেন তো?
বাংলাদেশিদের এই ব্যাপারটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাঁরা দেশের গত তিনটি নির্বাচনে কোনো অনিশ্চয়তা দেখতে পাননি। নির্বাচনগুলো হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা সেখানে করা হয়েছে পদ্ধতিগত কারচুপি। একজন ভোটারও ভোট দেওয়ার আগেই সবাই জানত নির্বাচনের ফলাফল কী হতে চলেছে। তা হলো শাসক দলের জয়।
ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রেও একই ‘ঝুঁকি’ বা অনিশ্চয়তার কথাটি প্রযোজ্য। একটি ন্যায্য বিচারের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে মৌলিক বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত এই একই অনিশ্চয়তা। অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হবেন, নাকি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন? বিচার শুরু হওয়ার আগেই কেউ যদি এর ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়, তাহলে কোনো ‘অনিশ্চয়তা’ থাকে না। তখন আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে বিচারপ্রক্রিয়াটা ন্যায্য হচ্ছে না।
আর উল্লেখিত নির্বাচনের মতোই, আওয়ামী লীগ সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের যে ফৌজদারি বিচার করেছিল সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশিদের একই উপসংহারে আসা উচিত।
খালেদা জিয়া কি কখনো দুর্নীতির দায় থেকে খালাস পেতেন? না। হেফাজতের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহতদের ‘মিথ্যা সংখ্যা’ দেওয়ার অভিযোগে আদিলুর রহমান খান কি দোষী সাব্যস্ত না হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল? নিশ্চয়ই না। মোহাম্মদ ইউনূস কি কখনো শ্রমবিধি লঙ্ঘন বা দুর্নীতির জন্য কারাদণ্ড থেকে রেহাই পেতেন? একেবারেই না।
আর সন্দেহ নেই, কোনো ধরনের অনিশ্চয়তাহীন বিচারের সবচেয়ে কুখ্যাত উদাহরণ যুদ্ধাপরাধের বিচারগুলো। আমরা সবাই জানতাম যে বিচারকেরা কখনোই জামায়াত এবং বিএনপির অভিযুক্ত নেতাদের তাঁদের ওপর আরোপকৃত একাত্তরের যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক অপরাধের দায় থেকে খালাস দেবেন না। সবাই জানতাম বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও তাঁরা সেটা করবেন না।
বিচারের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, মানে ন্যায্যতা, বিভিন্ন বিষয় দিয়ে নিশ্চিত করা হয়। তবে এর মধ্যে সম্ভবত দুটো বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বিচারপদ্ধতির ন্যায্য নিয়ম থাকা, যা বাদী বা বিবাদী কোনো পক্ষের আইনজীবীদের পক্ষে বা বিপক্ষে যাবে না।
দ্বিতীয়ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ মূল্যায়ন এবং আইন ও পদ্ধতিগত নিয়ম সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম এমন স্বাধীন ও যোগ্য বিচারক থাকা। বিচারকের আরও একটা ক্ষমতা থাকতে হবে। তা হলো, পর্যাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধ বা নির্দোষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা। আর সেই প্রমাণ কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব বা স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া চলবে না।
জুলাই ২০২৪-এর বিচার
এসব আলোচনা আমাদের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত বিচারের দিকে নিয়ে যায়। সরকার বলেছে এই মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) বিচার করা হবে। তাহলে এই বিচারগুলোতে কি ‘অনিশ্চয়তা’ থাকবে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে যার অর্থ আমরা কি বিশ্বাস করতে পারি যে অপরাধ প্রমাণের জন্য সন্দেহাতীত যথেষ্ট প্রমাণ হাজির করতে না পারলে বিচারকেরা অভিযুক্তদের খালাস দেবেন?
সরকার এখনো আইসিটি আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এবং পদ্ধতির বিধিগুলো নিয়ে পরামর্শ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা সেই তিনজন বিচারকের দিকে নজর ফেরাই, যাঁদের সরকার সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ দিয়েছেন। আইসিটি চেয়ারম্যান গোলাম মর্তুজা মজুমদার। তিনি অবসরপ্রাপ্ত জেলা আদালতের একজন বিচারক। মাত্র কয় দিন আগে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। দ্বিতীয় নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন মহিতুল হক মো. এনাম চৌধুরী। একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ। তৃতীয়জন হলেন আইনজীবী শফিউল আলম মাহমুদ। উনিও গোলাম মর্তুজা মজুমদারের মতো কয়েক দিন আগে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
এই নিয়োগগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিচারকদের কারোরই কর্মজীবনে কোনো মামলায় আন্তর্জাতিক আইনের নীতি প্রয়োগ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। আলোচ্য বিচারের সঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং তাকে ঘিরে থাকা জটিল আইন জড়িত। তাই এই অভিজ্ঞতা বিচারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা বলে মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, এই আইসিটি বিচারকদের মধ্যে দুজন হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা আদালতের বিচারক। তাঁরা বেশ কয়েক বছরে কোনো ধরনের ফৌজদারি মামলার বিচারক ছিলেন না। আন্তর্জাতিক আইনের জটিল বিষয় নিয়ে কাজ করার কথা বাদই দিলাম। গোলাম মর্তুজা মজুমদার অবসর নিয়েছেন ২০১৯ সালে। গত পাঁচ বছর তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেননি। এখন আইসিটি চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি হঠাৎ করে আপিল বিভাগের বিচারপতির পদমর্যাদা পেয়েছেন।
তৃতীয়ত, শফিউল আলম মাহমুদ একজন আইনজীবী। তিনি মাত্র ছয় দিন আগে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বিচারক হওয়ার আর কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর নেই।
এ ছাড়া শফিউল আলম মাহমুদ বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০১৯ সালে তিনি বিএনপির পক্ষ হয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে সরকার আইসিটি বিচারক হিসেবে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিল, যিনি এমন একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য, যারা আওয়ামী লীগের ঘোর বিরোধী। আর অনেক আসামি তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। উনি যদি স্বাধীনভাবে বিচারিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষমও হন, তবু ভুললে চলবে না যে তিনি এখনো বিচারকের দায়িত্ব পালন করেননি। আর তাঁর কাছ থেকে পক্ষপাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
চতুর্থত, বাংলাদেশে বহু বছরের অভিজ্ঞ হাইকোর্টের আরও অনেক যোগ্য বিচারক রয়েছেন। সে হিসেবেও, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি বিচারের জন্য অপেক্ষাকৃত নিম্ন মর্যাদার বিচারকদের বেছে নেওয়া হয়েছে।
এবং পঞ্চমত, তাঁরা সবাই বাংলাদেশি। এটাও একটা প্রাসঙ্গিক বিষয়। দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী আবেগ এখন খুব প্রবল। বাংলাদেশের বিচারকেরা, বিশেষ করে নির্বাচিত ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের কোনো জ্যেষ্ঠ সদস্যকে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলে কি বেকসুর খালাস দিতে পারবেন? এটা খুবই যৌক্তিক একটি প্রশ্ন। ১০ বছর আগে জামায়াত বা বিএনপির কোনো নেতাকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া সত্যিই সম্ভব ছিল? আজ কি তেমন কিছু সম্ভব হবে? এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হওয়া কঠিন।
যাঁরা ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচারের একটি ন্যায্য এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়া দেখতে চান, তঁাদের জন্য এই নিয়োগগুলো উদ্বেগজনক।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বিচারক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি ঠিকই বলেছেন। তবে আইন সহজেই পরিবর্তন করা যায়। আসলেই তাঁর মন্ত্রণালয় এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনীর খসড়া তৈরির কাজের মধ্যে রয়েছে।
তবু বলা যায় যে এই ধরনের দেশীয় প্রক্রিয়াগুলোতে আন্তর্জাতিক বিচারকদের কাজে লাগানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বসনিয়া, কসোভো, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন ও পূর্ব তিমুরে এমন নজির রয়েছে। আর আন্তর্জাতিক বিচারক যে পশ্চিমা দেশ থেকেই আসতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সেই বিচারক যেন অভিজ্ঞ ও স্বাধীন হন। আর সেই বিচারক নির্বাচনে জাতিসংঘ সহায়তা করতে পারে।
তবে এটা ঠিক যে আমরা এখনো জানি না সরকার আইসিটি আইন এবং পদ্ধতিগুলোকে কতটা ব্যাপকভাবে সংশোধন করবে। এই সংশোধনীগুলো বিচারের মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে। তবু বিচার প্রক্রিয়ার স্বাধীনতা আর সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করার স্বার্থে বাংলাদেশি বিচারকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিচারক নিয়োগের বিষয়টি বাংলাদেশের অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
ডেভিড বার্গম্যান সাংবাদিক। বহু বছর ধরে আইসিটির বিচার কার্যক্রম ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখছেন। তাঁর এক্স হ্যান্ডল @TheDavidBergman