২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাগুলোতে ঘটছে মানুষ-প্রযুক্তির মেলবন্ধন

টাইম ম্যাগাজিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক এ বিশেষ সংখ্যার সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ইশতিয়াক মান্নান। মূল লেখার সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন তিনি। আজকের মূল লেখাটি লিখেছেন পায়াল ধর। আগামী সপ্তাহের লেখা, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: স্যাম অল্টম্যানের চোখে’।

কিন্তু এআই সেই নির্ভাবনার মূলে ভালোভাবেই কুঠারাঘাত করেছে বলা যায়। ম্যাকেঞ্জির বিশ্লেষণ বলছে, পিএইচডি ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের উপযুক্ত কাজের ৫৭ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে জেনারেটিভ এআইয়ের দখলে বা প্রভাববলয়ে চলে যাচ্ছে, আর স্নাতক ডিগ্রিধারীদের উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্রে এটা ৬০ শতাংশ।

সুতরাং, যারা মেধা, শিক্ষা বা জ্ঞানভিত্তিক পেশায় সম্পৃক্ত, যেমন ব্যাংকার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, স্থপতি, গবেষণা বিজ্ঞানী, সফটওয়্যার ডেভেলপার, জেনারেটিভ এআই তাঁদের সবার কাজ অতি দ্রুতই পাল্টে দিচ্ছে এবং দেবে। এই পাল্টে দেওয়াটা ঠিক অটোমেশনের কারণে শ্রমিকদের ঢালাও কাজ হারানোর মতো না হলেও, কাজের ধরন (মানুষ কী করবে, কতটুকু করবে, কীভাবে করবে এবং এআই কতটুকু করবে ইত্যাদি) বদলে যাবে অনেকখানিই।

আর্থিক ও ব্যাংকিং খাত

সিটি ব্যাংক বেশ কয়েক বছর ধরেই গ্রাহকের চাহিদা, তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরন, ঝুঁকি কমানো, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজে এআই ব্যবহার করছে। কিন্তু জেনারেটিভ এআইয়ের ব্যাপক প্রচলন শুরু হলে গোল্ডম্যান স্যাকস, জেপি মরগ্যান—তাঁদের সঙ্গে মিলে এটা ব্যবহার না করার পক্ষেই একটা অবস্থান নিয়েছিল ব্যাংকটি। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসেই সবার অবস্থান পাল্টেছে। সিটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী জেন ফ্রেজার ২০২৩–এর জুলাইতে লিঙ্কডইনে লিখেছেন, ‘সামগ্রিকভাবে, জেনারেটিভ এআই ব্যবহার না করার ঝুঁকি একে ব্যবহার করার ঝুঁকির চেয়ে অনেক বেশি।’

কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে এই মুহূর্তে এআই ব্যবহারের বিকল্প দেখছে না আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা মনে করছে, এই খাতে এখন যেভাবে ক্লায়েন্টদের যুক্ত করা হয়, সেবা দেওয়া হয়, নিয়মনীতি মানা ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, সেগুলোও এআইয়ের ব্যবহারে বদলে যাবে। জেপি মরগ্যান ঘোষণা দিয়েছেন যে তাঁরা দুর্নীতি ও জালিয়াতি ঠেকাতে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলকে ব্যবহার করবেন ই–মেইল বিশ্লেষণের কাজে। এলি ব্যাংক মাইক্রোসফটের সঙ্গে অংশীদারত্বে চ্যাটজিপিটি যুক্ত করে নিজস্ব এআই মডেল তৈরি করেছে, যা দিয়ে ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়।

আইন

এই সিরিজের কোনো এক পর্বে দুজন আইনজীবীর যাচাই-বাছাই ছাড়া চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে শাস্তিস্বরূপ জরিমানা দেওয়ার কথা বলেছিলাম। তাঁরা এআই ব্যবহার করে যে ব্রিফ তৈরি করেছিলেন, তাতে পুরো বানোয়াট কেসের রেফারেন্স দেওয়া হয়েছিল। শুধু যে বানোয়াট বিষয়বস্তু তৈরি করে আইন পেশাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে তা নয়, এই চ্যাটবটগুলো ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বেশ নাজুক, যা পেশার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আশার কথা হচ্ছে, এই ভুলগুলোই কিন্তু এআইয়ের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। যখনই কারো একটা ভুল ধরা পড়ছে, তখনই পরবর্তী সংস্করণে সেই ধরনের ভুলের প্রতিরোধক যুক্ত হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরেই আইনজীবীরা তথ্য বিশ্লেষণ ও গবেষণার কাজে ‘লেক্সিসনেক্সিস’ কিংবা ‘থমসন রয়টার’–এর মতো বিশেষায়িত তথ্যভান্ডার ব্যবহার করেন। ‘লেক্সিসনেক্সিস’ বেশ কিছুদিন ধরেই তাদের সার্চ প্রযুক্তিতে মেশিন লার্নিং এবং এআই সক্ষমতা যুক্ত করে আসছে। জেনারেটিভ এআইয়ের উদ্ভাবনের ফলে এখন তারা তাদের এই বিশেষায়িত তথ্যভান্ডার দিয়ে একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলকে প্রশিক্ষণ দেবে। বোঝাই যাচ্ছে, সেই মডেল থেকে ভুল বা বানোয়াট তথ্য বা কেস রেফারেন্স দেওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

‘থমসন রয়টার’ ‘কো-কাউন্সেল’ নামে একটা বিশেষ এআই মডেল অধিগ্রহণ করেছে, যা একজন আইন সহকারীর কাজ করবে। চ্যাটজিপিটির বিশেষ সংস্করণযুক্ত এই সহকারী, ইউনিফর্ম বার পরীক্ষার বহুনির্বাচনী ও লিখিত পরীক্ষা পাস করেছে! ‘কো-কাউন্সেল’ একজন দক্ষ সহকারীর মতো কার্যবিবরণী (ডিপোজিশন) তৈরি করা, বিস্তারিত আইনি গবেষণা-মেমো লেখা কিংবা কোনো চুক্তিপত্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো বিশেষ করে যে অংশগুলো নীতিমালা বা আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় সেগুলো খুঁজে বের করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আইনের জগৎটাই তৈরি হয়েছে ভাষার ওপর। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করা হচ্ছিল যেন কম্পিউটার প্রযুক্তিকে এই ভাষার অলিগলি, ব্যাখ্যা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পার্থক্য বোঝার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। এআই আমাদের এত দিনের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে যাচ্ছে অভাবনীয় ও নির্ভরযোগ্য উপায়ে।’

প্রকৌশল

কয়েক দশক ধরেই প্রকৌশলীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রয়োজন পূরণে এআই ব্যবহার করে আসছেন। রোবটের নিয়ন্ত্রণ, কারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্যাটার্ন খুঁজে বের করা, সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন—এমন অনেক ক্ষেত্রেই এআইয়ের ব্যবহার হয়ে আসছে। এই বহুবিধ ব্যবহারের মধ্যেই এখন জেনারেটিভ এআই আরেক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে।

দুনিয়াজুড়ে বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন যার যার উপযোগী নিজস্ব সুনির্দিষ্ট এআই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। যেমন বিএমডব্লিউ তাদের গাড়িগুলোর ওজন কমাতে এবং ভারসাম্য আরো ভালো করতে বা বোয়িং তাদের প্লেনগুলোর পাখা এবং ফিউসেলাজের নতুন নকশা করতে এআই ব্যবহার করছে।

স্থাপত্য

ফ্লোরিডা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাইনের অধ্যাপক নিল লিচ বলছেন, কৃত্রিম হাত-পা যেমন করে ভিন্ন সক্ষমতার মানুষকে সাহায্য করে, তেমনি এআই একজন স্থপতির সক্ষমতাকে বহুগুণে ও বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিতে পারে। ইতিমধ্যেই এআই প্রাথমিক নকশা, ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি, সাইট পরিকল্পনা, অভ্যন্তরীণ নকশা তৈরির মতো কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থপতিরা বেঁচে যাওয়া সময়টুকু দিতে পারছেন উন্নততর স্থাপনা তৈরির জন্য দরকারি সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা করার কাজে। চীনের এআই–ভিত্তিক স্থাপত্যের সফটওয়্যার ‘এক্স-কুল’–এর প্রধান নির্বাহী বলছেন, তাঁর প্রযুক্তি ব্যবহার করলে একজন স্থপতি পাঁচজন স্থপতির সমপরিমাণ কাজ করতে পারবে।

অধ্যাপক লিচ গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেছেন, বৈপ্লবিক পরিবর্তনটা তখনই দেখা যাবে, যখন ‘ধারণা থেকে নির্মাণ’—এই পুরো যাত্রাটাই একটা প্যাকেজের মতো এআই প্রযুক্তির আওতায় আসবে। যদিও অনেক স্থপতি মনে করেন, এআইয়ের নকশায় ও সাহায্যে বানানো স্থাপনাগুলো সময়ের পরীক্ষায় পাস না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভালো, সেই পর্যন্ত পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।

সফটওয়্যার তৈরি

খোদ মাইক্রোসফট তাদের প্রকৌশলীরা যাতে প্রয়োজনমতো তথ্য পেতে পারেন সে জন্য চ্যাটবট ব্যবহার চালু করেছে। মাইক্রোসফটের সিনিয়র এআই প্রকৌশলী সাকসি মিশ্রা মনে করেন, সফটওয়্যার তৈরির ক্ষেত্রে প্রোটোটাইপ, পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন, পরীক্ষামূলক ধাপগুলো কমিয়ে নিয়ে আসা এবং ধারণা থেকে বাস্তবায়নের মধ্যাকার বিভিন্ন ধাপের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো—এসব ক্ষেত্রে জেনারেটিভ এআই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে; শুধু সতর্ক থাকতে হবে এ জন্য যে এআই সিস্টেমগুলো এখনো কিছু ভুল করতে পারে। তিনি বলছেন, ‘মানুষের সুপারপাওয়ার হচ্ছে তার সৃষ্টিশীলতা। আমরা নিত্যনতুন ধারণা সৃষ্টি করতে পারি। ডেটা নিয়ে নাড়াচাড়া ও বিশ্লেষণ আমাদের সুপারপাওয়ার নয়, সেটা এআইয়ের কাজ।’

পিট হার্জগ একজন হ্যাকার এবং সাইবার হুমকি–ঝুঁকি বিশ্লেষক, যাঁর কাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়ন। তিনি বলছেন, পাসওয়ার্ড তৈরি, অথেনটিকেশন, সাইবার হুমকি-ঝুঁকি চিহ্নিত এবং প্রতিরোধ করার সব কাজই এআই মানুষের চেয়ে অনেক ভালোভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে করছে। তাঁর মতে, সাইবার নিরাপত্তার মতো সংবেদনশীল কাজ মানুষের কাছ থেকে যত বেশি সরিয়ে নেওয়া যাবে, নিরাপত্তাব্যবস্থা ততই নিশ্ছিদ্র হবে।

সাইবার নিরাপত্তা ছাড়াও মাইক্রোসফটের ‘গিটহাব কো-পাইলট’ বা অ্যামাজনের ‘কোড হুইসপারার–এর মতো সফটওয়্যার তৈরির অন্যান্য দিকে যাঁরা কাজ করেন বা স্টার্টআপ উদ্যোগে যুক্ত আছেন, তাঁরাও বলছেন যে জেনারেটিভ এআই কোড লেখা থেকে শুরু করে সবগুলো ধাপেই উৎপাদনদক্ষতা প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে বড় কোম্পানিগুলোর দ্বিধা হচ্ছে যে জেনারেটিভ এআই ব্যবস্থার মধ্যে তাদের সফটওয়্যার যুক্ত হতে থাকলে ডেটার স্বত্ব ও গোপনীয়তা ঝুঁকির মুখে পড়বে। এ কারণে তারা একটু ধীরে চলো নীতি নিয়ে এগোচ্ছে।

সব মিলিয়ে এটা নিশ্চিত যে প্রযুক্তির দীর্ঘ এবং চলমান বিকাশের যাত্রায় এআই মানবজাতির জীবনে আরেকটা যুগান্তকারী বা খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার মতো প্রযুক্তি হতে যাচ্ছে। মেধা, শিক্ষা, জ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা বা কাজগুলো থাকবে ঠিকই, কিন্তু জেনারেটিভ এআই মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও ধীশক্তির পরিপূরক হয়ে উঠবে।

সব পেশাতেই বুদ্ধিজীবী মানুষ আর হয়তো রুটিন বা প্রাথমিক কাজগুলোতে সময়-শ্রম দেবে না, উচ্চতর, জটিল চিন্তাভাবনা ও সৃজনশীলতায় আরও বেশি মনোনিবেশ করতে পারবে। এর ফলে আরেকটি যে সম্ভাবনা তৈরি হতে যাচ্ছে তা হলো, এআই ও মানুষের মেলবন্ধন। আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি ভার্চ্যুয়াল এবং বর্ধিত বাস্তবতার জগতে (অগমেন্টেড রিয়েলিটি)। মানুষ ও এআইয়ের অংশীদারত্ব এবং মেলবন্ধন সেখানে কল্পনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের নতুন স্তরে মানবজাতিকে নিয়ে যাবে। যন্ত্র সেখানে সময় ও শ্রমসাধ্য কাজগুলো করবে আর মানুষ তার বহুমাত্রিক মেধা ও মননের শক্তিতে লিখবে, সৃষ্টি করবে, কৌশল নির্ধারণ করবে।

হার্জগ মজা করে বলেছেন, ‘আসলে কথা সেই পুরোনোই, যা হাজার হাজার বছর ধরে মা–বাবারা তাঁদের সন্তানদের বলে আসছেন—“শিখতে থাকো, শেখার মধ্যে থামাথামি নেই”, সেটা যে পেশাতেই হোক না কেন।’

  •  ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ