পুতিন কি জানেন ইউক্রেন কেন যুদ্ধ করছে

আমরা যুদ্ধের মধ্যে বসবাস করি। কিন্তু ভয় আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাছবি: রয়টার্স

গত নভেম্বরে আমার স্ত্রী ঠান্ডা শরতের মাটিতে অনেক টিউলিপ ও ড্যাফোডিলের চারা রোপণ করেছিলেন। ইচ্ছা ছিল যেন বসন্তে আমাদের গ্রামের বাড়ির চারপাশে অনেক ফুল ফোটে। আমাদের বাড়িটা রাজধানী কিয়েভ থেকে এক ঘণ্টার পথ। আমাদের প্রতিবেশীরা শীতকালের জন্য রসুন ও পেঁয়াজ বুনেছেন, ফুলগাছ লাগিয়েছেন এবং চাষ করা জমিতে সার ছিটিয়েছেন, পরবর্তী বছরের ফসলের কথা ভেবে।

কিন্তু বসন্ত আসার আগে শীত আছে। আর আছে যুদ্ধ।

যুদ্ধের সময় মানুষের সৌন্দর্যের প্রতি আকাঙ্ক্ষা শত গুণ বেড়ে যায়। খবরে আমাদের দেখানো হয় ধ্বংসস্তূপ। দেখানো হয় ইউক্রেনের শহর ও গ্রামের ধ্বংসাবশেষ থেকে টেনে তোলা মৃতদেহ। রাত ১০টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত হঠাৎ করে সাইরেন বাজে। তখন ইউক্রেনীয়রা বোমা থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রে ছোটেন। যাঁরা এই অকল্পনীয় কষ্ট সহ্য করছেন, তাঁদের অনেকে দখলকৃত অঞ্চল মুক্তির আশা এবং শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন স্বাধীনতা ফিরে আসার আশায়।

আমরা জানি না শান্তি আগে আসবে, নাকি বসন্ত। কিন্তু আমরা জানি বসন্ত অবশ্যই আসবে। যেখানে সবকিছু আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সেখানেও বসন্ত আসবে। ঘাস গজাবে পরিখায়, সৈনিকদের হাড়ের ভেতর দিয়ে, পুড়ে যাওয়া সাঁজোয়া যানগুলোর ওপরেও। যুদ্ধ ক্যালেন্ডার বা সময়কে থামাতে পারে না। কেবল জীবনের গতিকে থামায়।

ডিসেম্বরে আমাদের গ্রাম থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ভিসকে গ্রামের একটি হ্রদে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছিল। আমাদের গ্রামে বিস্ফোরণটি ভূমিকম্পের মতো অনুভূত হয়। আমাদের প্রতিবেশীরা ঘর ধসে পড়ার ভয়ে বাড়ির উঠানে ছুটে বেরিয়ে আসেন। অল্প কিছু বাড়ি টিকে ছিল। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই ভয় কেটে যায়। তার জায়গা নেয় ক্ষোভ এবং অটল বিশ্বাস যে ইউক্রেন রাশিয়ান আক্রমণকারীকে পরাজিত করবে। আমরা যুদ্ধের মধ্যে বসবাস করি। কিন্তু ভয় আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। 

ইউক্রেনীয়দের জন্য স্বাধীনতা সব সময়ই স্থিতিশীলতার চেয়ে, সম্পদের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আইনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই হচ্ছে রাশিয়ানদের সঙ্গে ইউক্রেনীয়দের প্রধান পার্থক্যগুলোর একটি। ইউক্রেনীয়দের জন্য স্বাধীনতা স্থিতিশীলতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ানদের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থিতিশীলতা। এই যুদ্ধ হচ্ছে এই পার্থক্য নিয়েই।

যখন রুশ সেনাবাহিনী গ্রামে এসে পৌঁছেছিল, তরুণ ইউক্রেনীয় কবি এবং শিশুসাহিত্যিক ভলোদিমির ভাকুলেঙ্কো তাঁর বাড়ি ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। রুশ সেনারা তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আগের দিন তিনি এই বর্বর সময়কাল নিয়ে লেখা ডায়েরিটি বাগানে পুঁতে রেখেছিলেন। আট মাস পর ইজিউমের একটি বনে তাঁর মৃতদেহ ‘৩১৯’ চিহ্নিত একটি কবর থেকে পাওয়া যায়। নিজের বাড়িতে নিজের মতো করে থাকার জন্য লেখককে চরম মূল্য দিতে হলো।

লেখক ও কবি ভিক্টোরিয়া আমেলিনা জানার চেষ্টা করছিলেন ভলোদিমিরের কী হয়েছিল, তা জানার। তিনিই ভলোদিমিরের ডায়েরিটি মাটি থেকে খুঁড়ে বের করে বই করে প্রকাশনার জন্য প্রস্তুত করেন। আমেলিনা যুদ্ধের শুরুতেই রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ নথিভুক্ত করতে শুরু করেন। বিদেশি লেখক এবং সাংবাদিকদের যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি অঞ্চলে নিয়ে যেতেন তিনি। এমনই এক যাত্রায় দনবাসের ক্রামাতর্স্ক শহরে যাচ্ছিলেন আমেলিনা। সেখানেই রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের শেল থেকে ছিটকে আসা টুকরার আঘাতে তিনি মারা যান। 

ভাকুলেঙ্কো এবং আমেলিনার মতো মানুষের হৃদয় থেকে উদ্ভাসিত স্বাধীনতার আকুতি তাঁদের দেশবাসীর জন্য পথপ্রদর্শক অনুপ্রেরণা। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে স্বাধীনতা প্রতিদিনের সংগ্রাম।

যদি কোনো সমাজ তার মানুষের স্বাধীনতাকে সম্মান করার প্রয়োজনীয়তা ভুলে যায়, তাহলে তাকে এক গভীর ঘুমন্ত বিস্মৃতির মধ্যে পড়ে যেতে হয়। এর পরিণতি ভয়াবহ, মর্মান্তিক হতে পারে। আমাদের চোখের সামনে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী এমন আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছেন, যা নিয়ে যাবে একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে। আমাদের চোখের সামনেই স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে মাথা নত করছেন।

রাশিয়া ইউক্রেনে ১১ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। এ যুদ্ধ ইউক্রেনীয়দের নিজের এবং দেশের স্বাধীনতাকে আরও বেশি ভালোবাসতে ও মূল্য দিতে শিখিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা কেবল বেঁচে থাকার অধিকার নয়। যুদ্ধ সত্ত্বেও ইউক্রেনীয় সমাজ স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, যুদ্ধরত একটি দেশ গণমাধ্যম বা প্রেসের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা রয়ে গেছে।

ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের ১০০-এর বেশি লেখক, কবি, প্রকাশক এবং অনুবাদক প্রাণ হারিয়েছেন। এই কথা মনে রাখতে হবে। কারণ, স্বাধীনতা ভুলে যাওয়া সহ্য করে না। ঠিক যেমন করে মাটি তৈরি করে বীজ বুনতে হয়, তেমনই স্বাধীনতা যত্ন দাবি করে। যদি স্বাধীনতা হারাতে না চাই, তবে আমাদের তাকে লালন করতে হবে।

আন্দ্রেই কুরকোভ ইউক্রেনীয় ঔপন্যাসিক

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন