বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ‘ছাত্ররাজনীতি’ একটি আপদের নাম। সম্প্রতি বুয়েট ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরাই ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করার জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট এক নিজস্ব আদেশে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে।
সম্প্রতি বুয়েটের এক ছাত্রলীগ নেতা উচ্চ আদালতে বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি চালু থাকার পক্ষে এবং রাজনীতি নিষিদ্ধের নোটিশটি বাতিলের জন্য রিট করেন। বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম খালেদ সারওয়ারের বেঞ্চ বুয়েটের ওই রাজনীতি নিষিদ্ধের নোটিশের ওপর ‘স্টে অর্ডার’ বা স্থগিতাদেশ প্রদান করেন।
এ স্থগিতাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে রাজনীতির বৈধতা আবার ফিরে এসেছে। অবশ্য বুয়েট কর্তৃপক্ষ ‘রিভিউ পিটিশন’ করতে পারে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সংগঠনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড কোনো সময়ই আইনত নিষিদ্ধ করা যায় না। কিন্তু রাজনীতির নামে যেসব কর্মকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে ক্যাম্পাসে হয়ে আসছিল, তা ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিবেশকে বিপন্ন করে এবং সাধারণ ও নিরীহ শিক্ষার্থীদের জীবন ও পড়াশোনাকে দারুণভাবে বিঘ্নিত করে।
এমন একটি বাস্তবতায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ‘ছাত্ররাজনীতি’ নিষিদ্ধের দাবি তোলেন। তাঁদের দিক থেকে এ দাবি অসংগত ও অযৌক্তিক নয়; কিন্তু দেশের সাংবিধান হয়তো তা পুরোপুরি সমর্থন করে না। বুয়েটের ব্যাপারে আদালতের আদেশ এভাবে বহাল থাকলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতেও ক্যাম্পাসের রাজনীতির বাড়াবাড়ির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দিলে তা আইনি জটিলতায় পড়বে।
এটি ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে ক্যাম্পাসে সংগঠন করার অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মানে কিছু ছাত্র নামধারীর যথেচ্ছাচার। এখানে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ পর্ষদগুলোর ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে তারা ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা রক্ষার যেসব বিধান তৈরি করেছে, তা প্রয়োগ করতে পারবে। এখানে আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। যেমন আবাসিক হলে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের জন্য হলে বসবাসের নিয়মাবলি, ক্যাম্পাসে পোস্টারিং, দেয়াললিখন, সভা-সমিতির অনুমতি ও শর্তাদি আরোপ, একাডেমিক শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি, ফৌজদারি অপরাধের জন্য পুলিশের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি উঠে যাওয়া বা শিথিল-কোনোটাই হওয়ার নয়।
তাই বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সম্মানিত শিক্ষকদের উদ্দেশে বলতে হয়, আদালত কোনোভাবে বুয়েটের বিরাজিত নিয়মনীতির ওপর কোনো শিথিলতা আরোপ করেননি। আদালত শুধু বাংলাদেশের যেকোনো প্রতিষ্ঠানে সংগঠন করার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ক্যাম্পাসে একাডেমিক পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বুয়েটে সব নিয়মকানুন দৃঢ়তার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে কোনোভাবে কুণ্ঠিত হওয়ার কারণ থাকে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কোনো ‘আইনি সত্তা’ হিসেবে স্বীকৃত নয়। এখানে আরপিও অনুসারে, রাজনৈতিক দলের যে নিবন্ধন নীতিমালা, তাতে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের স্বীকৃতি নেই। ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনগুলো আইনগতভাবে স্বীকৃত কোনো আইনি সংঘ বা নাগরিক সত্তা নয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আইনেও এ দলগুলো স্বীকৃত নয়। তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনও রাজনৈতিক দলের নামে হয় না। শিক্ষক সমিতিগুলো দলের কথা না বলে লাল, নীল, সাদা, হলুদ নানা রং ধারণ করে।
অতীতে ঔপনিবেশিক আমলে অনেক কিছুই হয়তো হয়েছে, যা স্বাধীন দেশে তার অনেক কিছুরই দার্শনিক ও প্রায়োগিক উপযোগিতা হারিয়েছে। ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গ এলে আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি এবং অতীত গৌরবগাথার কথা আওড়াতে থাকি। কিন্তু উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান বাস্তব অবস্থাটি বস্তুনিষ্ঠভাবে আলোচিত হয় না।
বাংলাদেশের ছাত্রসংগঠনগুলোর আইনি অবস্থান স্বচ্ছ নয়, সেটি স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। আইনি অবস্থান স্বচ্ছ না হলে ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে তাদের ভূমিকা, আইনশৃঙ্খলা–বিনাশী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সাংগঠনিক শৃঙ্খলার মধ্যে কীভাবে আসবে?
এখনো ইচ্ছা করলে ক্যাম্পাস ও একাডেমিক শৃঙ্খলার সব বিধিবিধান, ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনে শান্তিশৃঙ্খলাসহ শিক্ষার্থীদের রক্ষার জন্য বুয়েট বা বুয়েটের মতো একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলো কী কী করতে পারে, তার একটি নির্দেশনার জন্য একই আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। কারণ, ‘ছাত্ররাজনীতির’ নামে যদি বুয়েট ক্যাম্পাসে আবার অস্থিরতা সৃষ্টির ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের শান্তিপূর্ণ শিক্ষা পরিবেশ সুরক্ষার একটি বিধানও আদালত ঠিক করে দিতে পারেন। এর মাধ্যমে ক্যাম্পাস বিষয়ে আদালতের একটি যুগান্তকারী রায় ও পর্যবেক্ষণ আসা উচিত। তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির জন্য শুধু ক্যাম্পাস উন্মুক্ত করে দিলে এ বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ সুরাহা হবে না। ক্যাম্পাস জাতীয় রাজনীতির মাঠ বা মঞ্চ নয়।
অতীতে ঔপনিবেশিক আমলে অনেক কিছুই হয়তো হয়েছে, যা স্বাধীন দেশে তার অনেক কিছুরই দার্শনিক ও প্রায়োগিক উপযোগিতা হারিয়েছে। ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গ এলে আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি এবং অতীত গৌরবগাথার কথা আওড়াতে থাকি। কিন্তু উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান বাস্তব অবস্থাটি বস্তুনিষ্ঠভাবে আলোচিত হয় না।
সারা বিশ্বের সঙ্গে তুলনামূলক গুণমান বিচারে আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোথায় অবস্থান করে, তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বুয়েটের মতো হাতে গোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা বিশ্বমানের স্নাতক তৈরি করে। কোন ছাত্রসংগঠনের কত বড় নেতা এবং জাতীয় রাজনীতিতে কার কত প্রভাব, তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে কিছু আসে যায় না। যদি আমরা আমাদের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনকে বিশ্বমানের দিকে এগিয়ে নিতে চাই, তাহলে সস্তা স্লোগানধর্মী বক্তব্য থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
এ ক্ষেত্রে বুয়েট যেহেতু কাজটিতে হাত দিয়েছে, তাদের এর শেষ দেখতে হবে। উচ্চ আদালত যে স্থিতাবস্থা জারি করেছেন, তার রিভিশনের জন্য সঠিক যুক্তিগুলো দাঁড় করিয়ে নতুন পিটিশন করতে হবে। দেশে কি উচ্চশিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ থাকবে, নাকি সেখানে কিছু রাজনৈতিক নেতা তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে যা খুশি তাই করবেন। হল দখল, সিট ব্যবসা, ছাত্র নির্যাতন, জোর করে মিছিল-সমাবেশে নিয়ে যাওয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নিয়োগে বখরা, শিক্ষক-এমনকি উপাচার্য নিয়োগে প্রভাব বিস্তার—এসব কি দায়দায়িত্বহীন রাজনীতির কুফল নয়?
আদালত থেকে এ বিষয়ে একটি নির্দেশনার জন্য বুয়েটকে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতিসহ আদালতে যাওয়ার অনুরোধ করছি।
● তোফায়েল আহমেদ শিক্ষক, গবেষক ও শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ