একজন নারী আসলে কতভাবে যৌন হেনস্থা বা হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার হতে পারেন?
এই পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সমাজে এমন কোনো নারী খুঁজে পাওয়া খুবই মশকিল হবে, যে এমন বেদনাদায়ক ও অসহনীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি।
জীবনের পরতে পরতে নানাভাবে নানা মুহুর্তে এই ভয়াবহতার মুখে পড়তে হয় একজন নারীকে। এরকম অনেকগুলো ঘটনা একজন নারীর জীবন থেকে দেখে নেওয়া যাক।
এক.
রুনার (ছদ্মনাম) বয়স তখন ১২ বছর। উত্তরবঙ্গের একটি জেলা শহরে থাকত ওরা। রুনারা এক ভাই, এক বোন। একবার প্রচণ্ড বন্যা হয় ওদের এলাকায়। রুনাদের ঘরে বন্যার পানি ওঠে। সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে দুই ভাই-বোনকে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন রুনার মা-বাবা।
মামার বাড়িতে থাকাকালে একদিন গভীর রাতে হঠাৎ রুনার ঘুম ভাঙে শরীরে অযাচিত কোনো হাতের স্পর্শে। আলো-আঁধারিতে সে খুঁজে পায় তার নিজের মামাকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রুনা হাত দিয়ে ঠেলে ওঠায় পাশে ঘুমিয়ে থাকা ছোট ভাইকে। চোখ কচলাতে কচলাতে ভাইটি উঠে বসতেই হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মামা।
তিনি আর কখনো রুনার ঘরে ফিরে না এলেও ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতা রুনার মনে স্থায়ী হয়ে যায়। সে অনেকবার ভেবেছে, মামার আসল চেহারা একদিন মাকে জানিয়ে দেবে। কিন্তু কোনো এক অস্বস্তি বারবার রুনার গলা চেপে ধরেছে। রুনার কিছুই বলা হয়নি মাকে।
দুই.
রুনা তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। পরীক্ষায় সব বিষয়ে ভালো করলেও অঙ্কে দিন দিনই পিছিয়ে পড়ছিল সে। নিরুপায় হয়ে এক শিক্ষকের কাছে ব্যাচে অন্যদের সঙ্গে পড়ায় ইচ্ছার কথা জানাতেই বেঁকে বসলেন বাবা। কারণ, মেয়ের চলার পথের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি। অনেক বুঝিয়ে অবশেষে বাবাকে রাজি করাল রুনা। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই বখাটে ছেলেদের উপদ্রবের মুখে পড়ল সে।
একদিন পথের মাঝে এক ছেলে হ্যাঁচকা টান দিল তাকে। এরপর জোর করে হাতে ধরিয়ে দিল চিঠিসহ গোলাপ ফুল। ঘৃণাভরে চিঠি ও গোলাপ ছুড়ে ফেলল সে। বাসায় ফিরে বলব বলব করেও বাবাকে বলা হয়নি সেদিনের সেই অপমানের কথা। বললে বাবা যদি ব্যাচে পড়তে যাওয়া বন্ধ করে দেন! বন্ধুদের সহায়তা নিয়েই কোনোরকমে পড়া চালিয়ে যায় রুনা।
তিন.
এসএসসি পরীক্ষায় দারুণ ফল নিয়ে রুনা ভর্তি হয়েছে স্থানীয় সরকারি কলেজে। প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঘটে আরেকটি ঘটনা।
বেঞ্চের একপ্রান্তে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিল সে। পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের একজন রুনাকে বেঞ্চের ভেতরের দিকে সরে বসতে বললেন। রুনা সরে বসতেই শিক্ষক রুনার জায়গায় বসে পড়লেন। শিক্ষকের হাতে একটি বই। বই পড়ার ছলে শিক্ষকের হাতের কনুই নির্লজ্জভাবে বারবার রুনার শরীর স্পর্শ করতে থাকল। রুনা কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
অবশেষে রুনার পাশে দাঁড়াল বেঞ্চের অপর প্রান্তে থাকা ছাত্রটি। ছেলেটি উচ্চ স্বরে রুনাকে বলল, ‘তুমি আমার জায়গায় বসো। আর আমি তোমার জায়গায় বসছি।’
ঘটনার আকস্মিকতায় সেই শিক্ষক হকচকিয়ে গেলেও তা প্রকাশ করলেন না; চুপচাপ উঠে গেলেন। রুনা বাসায় ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদল। কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগ জানানোর ইচ্ছা থাকলেও মায়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত কিছুই করল না। সেদিনের সেই ঘটনা আজও ভোলেনি রুনা।
জীবনজুড়ে যৌন নিপীড়নের চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে রুনারা শুধুই কুঁকড়ে যায়, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে ওঠা হয় না রুনাদের। অকার্যকর যৌন হয়রানি নির্মূল কমিটি আর বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে বাঁধা পড়ে নিশ্চুপ রুনারা যন্ত্রণাময় একটি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। এই নীরবতার শেষ কোথায়?
চার.
দেশের প্রথম সারির একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছে রুনা। পরপর তিন বছর প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে সে। কয়েক মাস পরই অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। একদিন হঠাৎ ডিপার্টমেন্টের এক প্রভাবশালী শিক্ষকের কাছ থেকে মুঠোফোনে বার্তা পেল রুনা। শিক্ষক পরদিন তাকে তাঁর কক্ষে দেখা করতে বলেছেন।
পরদিন দুরুদুরু বক্ষে শিক্ষকের কক্ষে হাজির হলো সে। শিক্ষক ইনিয়ে-বিনিয়ে বোঝালেন তিনি কতটা পছন্দ করেন রুনাকে এবং ফাইনাল পরীক্ষাতে ভালো ফল নিশ্চিত করতে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টিও আকারে–ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন। ব্যতিক্রম হলে কী পরিণতি হতে পারে, তা–ও কৌশলে জানিয়ে রাখলেন।
রুনার আর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম হওয়া হয়নি। পূরণ হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নটিও। খুব কাছের দুজন বন্ধু ছাড়া সেদিনের সেই ঘটনা আর কাউকে জানানো হয়নি।
পাঁচ.
পড়াশোনা শেষ করে রুনা তখন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করে। অফিসের পরিবেশ নারীবান্ধব, আছে কর্মী সুরক্ষায় নানা নীতিমালা। চাকরির প্রথম কয়েকটি বছর নিরুপদ্রব কেটে গেলেও হঠাৎ একটি সমস্যার মুখোমুখি হয় সে।
নতুন বস কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে কাজ করতে একধরনের অস্বস্তি বোধ করছিল রুনা। একদিন একটি রিপোর্ট বসের দিকে এগিয়ে দিতেই হঠাৎ রুনার হাত স্পর্শ করে বসেন তিনি। রুনা কোনোরকমে হাত ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
এরপর সাহস করে হয়রানির বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে জানায় সে। তিনি পুরো ঘটনা মন দিয়ে শোনেন এবং রুনাকে সমবেদনাও জানান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের যৌন হয়রানি নির্মূল কমিটিকে জানানোর প্রসঙ্গে তিনি রুনাকে বলেন, তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণ করা খুব কঠিন।
রুনা ভেবে দেখে, তার কাছে তেমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তাই আর অভিযোগ করা হয় না রুনার।
দুই মাসের মাথায় বর্তমান বেতনের চেয়ে কম বেতনে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয় রুনা।
এভাবে যৌন হয়রানি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে রুনাদের জীবন। রুনাদের বলা হয় না কিছুই। রুনার এই নীরবতা প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক নারীর যৌন হয়রানিতে নীরবতার ইতিহাস। এর বাইরে চলার পথে, গণপরিবহনে আর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে হয়রানি তো আছেই।
প্রথম আলো প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০ শতাংশ ছাত্রী কোনো অভিযোগ করেন না। এ ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচার কোথায় পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে প্রচারের ঘাটতি, অসহযোগিতা, লোকলজ্জা, মেয়েদের পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় ইত্যাদি।
প্রতিবেদনটিতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরলেও পরিবারসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের চিত্র অনেকটা একই রকম। অধিকাংশ নির্যাতনের প্রমাণ থাকে না। আবার প্রমাণ থাকলেও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে না। ১০ শতাংশ অভিযোগের মধ্যে বিচার প্রাপ্তির হার ৩ শতাংশেরও কম।
জীবনজুড়ে যৌন নিপীড়নের চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে রুনারা শুধুই কুঁকড়ে যায়, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে ওঠা হয় না রুনাদের। অকার্যকর যৌন হয়রানি নির্মূল কমিটি আর বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে বাঁধা পড়ে নিশ্চুপ রুনারা যন্ত্রণাময় একটি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। এই নীরবতার শেষ কোথায়?
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী