হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা ৭ অক্টোবরের পর থেকে নাটকীয়ভাবে তীব্র আকার ধারণ করে। দুই পক্ষকে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। সম্প্রতি সংঘাতের তীব্রতা ও মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে দুই পক্ষ যেকোনো সময় সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়তে পারে।
আমরা যখন যুদ্ধের কিনারে পৌঁছে যাওয়ার কথা বলছি, তার মানে হচ্ছে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতির কাছাকাছি একটা জায়গায় চলে এসেছে। সম্প্রতি দুই পক্ষের মধ্যে হিংসা-বৈরিতা যেভাবে বেড়েছে, সেটাকে সংঘাতের গতিমুখ বদলে দেওয়ার একটা সূচনাবিন্দু বলে মনে হতে পারে। দুই পক্ষই সম্ভাব্য একটা দীর্ঘস্থায়ী ও বিপজ্জনক যুদ্ধের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত করছে বলে মনে হতে পারে।
এ মাসে হিজবুল্লাহর সবচেয়ে উঁচু সারির ফিল্ড কমান্ডারদের একজন আবু তালেবকে হত্যা করে ইসরায়েল। এ ঘটনায় হিজবুল্লাহ প্রতিশোধমূলক হামলা চালালেও এখন পর্যন্ত নিজেদের জোর করে সংযত রেখেছে বলে মনে হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলও তাদের দিক থেকে এখনো লাল রেখা অতিক্রম না করার ব্যাপারে সতর্ক। এরপরও দুই পক্ষের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনাটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি ও দোরগোড়ায় তাদের উপস্থিতি বিবেচনায় গাজার হামাস থেকে হিজবুল্লাহকে ইসরায়েল তাদের অস্তিত্বগত হুমকি বলে মনে করে। জটিল এ পরিস্থিতি শুধু ইসরায়েলের ওপর নয়, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের বৃহত্তর স্বার্থের ওপর ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
আপাতভাবে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল—দুই পক্ষের কারোরই বিপজ্জনক সীমারেখা অতিক্রমের অভিপ্রায় নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলা এবং গাজা সংঘাতের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে দুই পক্ষের কোনো একটা পক্ষ বড় কোনো ভুল করে বসতে পারে। তাতে যেকোনো সময়ই সরাসরি যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
এ ছাড়া দুই পক্ষ বর্তমানে যে নিয়মনীতি বজায় রেখে চলছে, তাতে আকস্মিকভাবে কোনো বড় ধরনের বদল হলে, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও দুই পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আগ্রহ ক্রমেই কমে যাওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রাথমিকভাবে এ সংঘাতের গুরুত্ব হারানোর কারণ হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচারণা পর্ব। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যার চাপে গাজা যুদ্ধ এখন চাপা পড়ে গেছে।
মার্কিন ভোটাররা মূলত অর্থনৈতিক সমস্যা ও অভিবাসী—এ দুই বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন। দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী খুব গভীরভাবে দেশীয় রাজনীতি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার বিষয়টি সামনে আসায় বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত পক্ষগুলোকে, বিশেষ করে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগটা সীমিত হয়ে পড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলপন্থী লবি ক্ষমতায়িত হবে। তারা হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নীতি রক্ষায় আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে। নেতানিয়াহু সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনকে তারা বাধা দেবে।
এ প্রেক্ষাপটের কারণে আসন্ন সংকটের যে গুরুত্ব, সেটা খাটো হবে। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা থেকে বেনি গানৎসের সরে যাওয়ার পরও ইসরায়েল সরকারের ভাগ্য খারাপ হয়ে যায়নি। বেনি গানৎসে এমন একজন প্রভাব তৈরিকারী রাজনীতিবিদ, যাঁকে যুক্তরাষ্ট্রবান্ধব বলে মনে করা হয়। যাহোক নেতানিয়াহু তাঁর যুদ্ধ মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ায় সেটা লেবানন ফ্রন্টে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
লেবানন এ মুহূর্তে একটা বিপজ্জনক পর্ব পার করছে। দেশটি খাদের এমন কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে যে সামনে পা বাড়ালেই অতল গহ্বরে পড়ে যেতে হবে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরানের প্রক্সি হিজবুল্লাহর বিচরণক্ষেত্র হওয়ায় আঞ্চলিক সংঘাতের প্রধান মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে লেবানন।
হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি ও দোরগোড়ায় তাদের উপস্থিতি বিবেচনায় গাজার হামাস থেকে হিজবুল্লাহকে ইসরায়েল তাদের অস্তিত্বগত হুমকি বলে মনে করে। জটিল এ পরিস্থিতি শুধু ইসরায়েলের ওপর নয়, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের বৃহত্তর স্বার্থের ওপর ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
বৈশ্বিক পরিসরে হিজবুল্লাহ সম্প্রতি তাদের যে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে, সেটা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার বদলে বরং পতনের একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।
দৃশ্যমানভাবে তীব্র হওয়া উত্তেজনা ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর পাশাপাশি অবস্থান, কত দিন টেকসই থাকবে, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সরাসরি যুদ্ধ এখন না–ও বাধতে পারে। কিন্তু আসন্ন দিনগুলোতে বড় কোনো সংঘাতের কালো ছায়া মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ঝুলছে।
এদিকে সাধারণ লেবাননি নাগরিকেরা যে প্রশ্ন নিয়ে সরগরম হয়ে পড়েছেন, যে সংঘাত ইসরায়েলের চেয়ে লেবাননের ওপর অনেক বেশি চাপ তৈরি করেছে সেটি থামানোর সময় কি হয়নি।
● আলী হামাদে লেবাননের আনাহার পত্রিকার সাংবাদিক
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত