পরপর দুই সপ্তাহে শিক্ষাঙ্গনে বড় দুটি সহিংসতার ঘটনা ঘটে গেল। ২০ নভেম্বর রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়াল। তিন দিনের ব্যবধানে ২৪ নভেম্বর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পরদিন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা হলো। এসব সংঘর্ষ ও হামলায় অন্তত ৬০-৭০ জন আহত হয়েছেন। ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদের।
এক শিক্ষার্থী অন্য শিক্ষার্থীর ওপর যেভাবে লাঠিসোঁটা-রড নিয়ে হামলা করেছেন, তা চোখে দেখে সহ্য করার মতো নয়। তাঁদের বয়সের দিকে তাকালে তা মেনেও নেওয়া যায় না। জুলাই অভ্যুত্থানের বাস্তবতায় পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে কৌশল নির্ধারণে ভুল করছে। শিক্ষার্থীরাও অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক অবস্থা দেখে মনে হয় না, শিক্ষার্থীরা আদৌ পড়ার টেবিলে ফিরতে পেরেছেন।
দুটি ঘটনার কোনোটিই এমন ছিল না, যাতে সংঘাত-সংঘর্ষ এত দূর গড়াতে পারে। ২০ তারিখে সায়েন্সল্যাব এলাকায় যে ঘটনা ঘটেছে, তার সূত্রপাত আগের দিন। সেই ঘটনা মামুলি। ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্রের একটি বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে তাঁদের সঙ্গে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতাহাতি হয়। ছাত্রদের মধ্যে সহনশীলতা থাকলে হয়তো হাতাহাতির ঘটনাও ঘটত না। এর জের ধরে পরদিন সিটি কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ঢাকা কলেজের দুটি বাস ভাঙচুর করেন। পরে ঢাকা কলেজের ছাত্ররাও জোটবদ্ধ হয়ে সিটি কলেজে গিয়ে হামলা চালান। দফায় দফায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
আর ২৪ তারিখের ঘটনার সূত্রপাত ১৮ নভেম্বর ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেলে এক ছাত্রের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ওই শিক্ষার্থী ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের। ভুল চিকিৎসায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এ অভিযোগ তুলে ওই কলেজসহ আরও কিছু কলেজের শিক্ষার্থী ২০ তারিখ ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। পরে মৃত্যুর ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হয়তো ঘটনার এখানেই সমাপ্তি হতে পারত। কিন্তু ওই দিন বিকেলে হাসপাতালের পক্ষ নিয়ে সোহরাওয়ার্দীসহ আশপাশের কলেজের শিক্ষার্থীরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করেন। এর জের ধরে ২৪ ও ২৫ তারিখ হাসপাতাল ও কলেজ দুটিতে পাল্টাপাল্টি ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীরা এত অসহনশীল হয়ে উঠছেন কেন। সামনে শিক্ষাঙ্গনে নতুন করে আর কোনো সহিংসতা বা হামলার ঘটনা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তাই–বা কে দিতে পারে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কী হবে, সেটি বুঝে ওঠা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অস্থির থাকলে সামগ্রিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি রাষ্ট্রের সংস্কারকাজও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ছাত্রদের আস্থায় রেখেই এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতনের সূত্রে ছয়-সাত মাস ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কের যে চেইন বা শৃঙ্খল ছিল, তা অনেক ক্ষেত্রেই নষ্ট হয়েছে। এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। শিক্ষকেরাও পারেননি তাঁদেরকে পুরোপুরি আস্থায় নিতে কিংবা ক্লাস-পরীক্ষায় মনোযোগী করতে। শিক্ষার্থীরা নিজেরাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেদেরকে প্রতিপক্ষ মনে করছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত যে অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, তার সুরাহার উপায় নিয়েও দ্বিধা আছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে।
সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। যেসব বড় বড় ঘটনার সাক্ষী তাঁরা হয়েছেন, সেসব ঘটনার পরিণতি তাঁদের জন্য স্বস্তিকর ছিল না। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই যৌক্তিক দাবি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে থামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ২০২০ সালে কোভিড মহামারির আক্রমণে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা ঘরে বন্দী ছিলেন। এর ফলে তাঁদের পড়াশোনার যে ঘাটতি হয়, তা পূরণ করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর এই জুলাই-আগস্টের অভিজ্ঞতা তো রীতিমতো ভয়াবহ! সরাসরি বুলেট আর রক্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ!
এসব ঘটনায় নিশ্চিতভাবেই মানসিক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিকারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সত্যি কথা বলতে, মানসিক যত্ন যে দরকার, সেটি একেবারেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। তবে তা খুবই সীমিত পর্যায়ে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এই কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছেন।
শিক্ষার্থীদের গত কয়েক মাসের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে, শিক্ষার বিদ্যমান অবস্থা আর ব্যবস্থা নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। তাঁরা দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নিয়েও মনঃক্ষুণ্ন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্র সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিক্ষা সংস্কার। পড়াশোনার টেবিলে যাওয়ার আগে তাই তাঁরা বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন চান। তাঁরা এটাও বোঝেন, এর আশু সমাধান নেই। তবে অন্তত সংস্কারের নিশ্চয়তা চান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা কমিয়েছে। যেমন যে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, সেই ছাত্ররাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কক্ষ বরাদ্দ ও নাম তালিকাভুক্ত করার কাজটি দ্রুত সমাধান করে আবাসিক হলগুলোয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। সক্ষমতা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন বিভাগ ধাপে ধাপে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করেছে। এ ছাড়া ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংকট দূর করতে প্রতিটি বিভাগ নিজের মতো করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। একই কাজে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রতিটি বিভাগ আলাদাভাবে শিক্ষক, ছাত্র উপদেষ্টা ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে কমিটি গঠন করে।
সহিংসতার পক্ষে কোনো শিক্ষার্থীই নন। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাও সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকতে চাইবেন, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা পেলে তাঁরা নিজেদের হাতে আইনও তুলে নিতে চাইবেন না। তবে সবার আগে দরকার এই শিক্ষার্থীদের আস্থায় আনা। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের কথা শুনতে হবে, সমস্যাগুলোকে সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে এবং সেগুলো সমাধানের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক