গুলশান লেকের পাড়ে অনেক পুরোনো একটি ভবনের দোতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের বছর দেড়েক পর থেকে। দুটি বেডরুমের মাঝে একটা বারান্দা। বারান্দায় বসলে ঠিক নিচেই লেকের পানি দেখা যায়। অন্য পাড়ে কানাডা, নেপাল ও ভারতের দূতাবাস। ঢাকা শহরে বাস করে এর চেয়ে মনোরম আর কী আশা করা যায়!
কিন্তু এই বারান্দায় বসা যায় না। বারান্দার দরজা তো বটেই, বেডরুমের জানালাও বন্ধ রাখতে হয়। মশার যন্ত্রণা তো আছেই, তবে মূল সমস্যা হচ্ছে লেকের পানির উৎকট পচা দুর্গন্ধ। প্রবল বৃষ্টির মৌসুমে দুর্গন্ধটা সহনীয় পর্যায়ে আসে। ওপরতলার বাসিন্দারা অনেকটা রক্ষা পান। আমার মতো দোতলাবাসীকে বছরে ৯ মাস এই প্রবল দুর্গন্ধের সঙ্গেই সহাবস্থান করতে হয়।
গুলশান লেকের ওপর দিয়ে তিনটি রাস্তা লেকটিকে বাস্তবে কয়েকটি বড় পুকুরে ভাগ করেছে। সর্ব দক্ষিণে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড লেকের একাংশকে আলাদা করে হাতিরঝিলের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। বাকি দুটি রাস্তার একটিতে সেতু আছে, সেই সেতু লেকের প্রস্থের তুলনায় অনেক কম। রাস্তা দিয়ে লেক অনেকখানি বন্ধ করে মাঝে খানিকটা সেতু। আরেক রাস্তায় তা–ও নেই, মাঝখানে শুধু পাইপ দিয়ে খানিকটা পানি চলাচলের ব্যবস্থা।
মেয়র অবিলম্বে এগুলোকে ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে যুক্ত করতে অথবা প্রতিটি বাড়িতে ইটিপি স্থাপনের নির্দেশ জারি করেছিলেন। তাঁর আক্ষেপ ছিল, বিত্তশালী মানুষেরা এ এলাকায় থাকেন, অথচ লেকে ময়লা ফেলার ব্যাপারে তাঁরা নির্বিকার। বাড়ির মালিকেরা কেন ওয়াসার লাইনে যুক্ত না হয়ে লেকে বর্জ্য ফেলাকেই বেছে নিয়েছেন, তা আমার বুঝে আসে না। এখানে কি ওয়াসারও দায় নেই?
প্রতিটি রাস্তার দুপাশে ময়লা জমে জমে বীভৎস দৃশ্য, অসহনীয় দুর্গন্ধ তো আছেই। সেতুর নিচে বাঁশের বেড়া ও জাল; মাছ চাষের সুবিধার্থে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে অবশ্য পানি চলাচল করতে পারে। মাছ চাষের জন্য সম্ভবত ইজারাদার আছেন, একটি নৌকা করে নিয়মিত মাছের খাবার ফেলেন তাঁর কর্মীরা। এই বিষাক্ত পানি থেকে ধরা মাছ বাজারে বিক্রি হয় এবং আমরা তা কিনে খাই। মাঝেমধ্যে পানির মান এমন পর্যায়ে যায় যে কিছু মাছ মরে ভেসে ওঠে। সেসব মাছ পচে গিয়ে লেকের দুর্গন্ধের মাত্রা তখন অবর্ণনীয় উচ্চতায় পৌঁছে যায়।
লেকের এই দুরবস্থা কেন? এর তিন পাড়ের আবাসিক এলাকাগুলোর সুয়ারেজের অধিকাংশ বর্জ্য মোটা পাইপের মাধ্যমে এই লেকে এসে পড়ে। পাশাপাশি ময়লা–আবর্জনা সরাসরি লেকে ফেলছেন গৃহকর্মীরা। ফলে লেকটি এখন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম সারফেস ড্রেন এবং লেকে যুক্ত সুয়ারেজ লাইন বন্ধের একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেক লাইন কলাগাছ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন যে বাড়ির মালিকেরা ব্যবস্থা না নিলে স্থায়ীভাবে বন্ধের ব্যবস্থা করা হবে।
করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী গুলশান, বারিধারা, বনানী, নিকেতন এলাকার ৩ হাজার ৮৩০টি বাড়ির মধ্যে ২ হাজার ২৬৫টির সুয়ারেজ সারফেস ড্রেন বা লেকের সঙ্গে যুক্ত (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১১ জানুয়ারি ২০২৩)। মেয়র অবিলম্বে এগুলোকে ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে যুক্ত করতে অথবা প্রতিটি বাড়িতে ইটিপি স্থাপনের নির্দেশ জারি করেছিলেন। তাঁর আক্ষেপ ছিল, বিত্তশালী মানুষেরা এ এলাকায় থাকেন, অথচ লেকে ময়লা ফেলার ব্যাপারে তাঁরা নির্বিকার।
বাড়ির মালিকেরা কেন ওয়াসার লাইনে যুক্ত না হয়ে লেকে বর্জ্য ফেলাকেই বেছে নিয়েছেন, তা আমার বুঝে আসে না। এখানে কি ওয়াসারও দায় নেই? মেয়রের বিকল্প প্রস্তাবটি এককথায় অভিনব এবং অবাস্তব। অনেক চেষ্টা করেও শিল্পকারখানাতেই ইটিপি চালু করা যায়নি। কারখানার বর্জ্য নদীগুলোকে হত্যা করেছে।
এখন প্রতিটি বাড়িতে ইটিপি চালুর নির্দেশ হলে তাতে ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের আয়–উন্নতির আরেকটি পথ প্রশস্ত হবে। মেয়রের ক্ষোভ সত্ত্বেও তাঁর দুই প্রস্তাবের কোনোটাই অবশ্য কার্যকর হয়নি। লেকের পরিবেশও পাল্টায়নি গত ১৫ মাসে।
গত ১৬ মার্চ বেশ জোরেশোরে ‘গুলশান লেক পরিচ্ছন্নতা ড্রাইভ’ উদ্বোধন করেন মেয়র। এর শুরুতে একটি র্যালি অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মেয়রের পাশে ছিলেন সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। ইংরেজিতে লেখা পোস্টার হাতে আরও ছিল কয়েকটি স্কুলের শিশুরা। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘স্থানীয় বাসিন্দারা গুলশান লেক পরিচ্ছন্নতা শুরু করেছেন’।
র্যালির পর দুটি খননযন্ত্র দিয়ে লেকের কিনারে পানির নিচ থেকে কুচকুচে কালো গলিত আবর্জনা তোলার দৃশ্য চিত্রায়িত হয়। এরপর সবাই প্রস্থান করেন। এরূপ প্রতীকীমূলক পরিচ্ছন্নতা অভিযান আগেও হয়েছিল কিন্তু সচেতনতার কোনো লক্ষণ অবশ্য দৃশ্যমান হয়নি।
গুলশান লেকের রোগ অনেক গুরুতর এবং সেটিকে টোটকা ওষুধ দিয়ে সারানোর প্রত্যাশা হবে নির্বুদ্ধিতা। চিকিৎসা কী লাগবে, বিশেষজ্ঞরা তা নির্ধারণ করবেন।
তবে সাধারণ দৃষ্টিতে কয়েকটি পদক্ষেপ অবশ্য প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়:
১. লেকের দুই পাড় ধরে যথার্থ ধারণক্ষমতার সুয়ারেজ লাইন করতে হবে সবার আগে, যাতে বাড়ির মালিকদের সারফেস ড্রেনের সঙ্গে সুয়ারেজ সংযোগ দিতে না হয়।
২. আবর্জনা লেকে আসা বন্ধ করার পর পাম্প লাগিয়ে সব নোংরা পানি বের করে দিতে হবে।
৩. লেকের তলায় চার থেকে পাঁচ ফুট পুরু গলিত আবর্জনার স্তর জমা হয়েছে। এই আবর্জনা কেটে সরিয়ে লেকের মূল পরিষ্কার মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে।
এরপর যদি আর আবর্জনা প্রবেশের সুযোগ দেওয়া না হয়, এক বর্ষার বৃষ্টি এবং আশপাশের রানঅফের পানিতে লেক ভরে যাবে।
কাজটি সহজ নয়। বিপুল অর্থ এবং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দরকার হবে এ জন্য। সমস্যা হচ্ছে, লেকের মালিক রাজউক, তাদের এসব ছোটখাটো বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়। সুয়ারেজ লাইনের মালিক ওয়াসা, যার এমডি তাকসিম খান কিছু না করেই সাতবার বিপুল বেতনে চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি কেন এসব ঝামেলা করতে যাবেন। মেয়র সাহেব শুধু রাস্তা আর সারফেস ড্রেনের মালিক। তিনি যদি আন্তরিকও হন, কিছু করা তাঁর জন্য কঠিন।
সমাধানের পথ একটাই। এ দেশে অপরাধীদের গ্রেপ্তারে বা বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা লাগে। মেয়র আতিক যদি তাঁর সম্মতি লাভ করতে সক্ষম হন, সাত দিনের মধ্যে রাজউক এক টাকা প্রতীকী মূল্যে লেকটি ডিএনসিসিকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে পারে, তাকসিম খানের সুবিধাদি বহাল রেখে তাঁকে পাশ কাটিয়ে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, আর এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রাপ্তিও সম্ভব হতে পারে। চেষ্টা করে দেখুন না মেয়র সাহেব।
যদি সফল হন, তাহলে আরও কয়েকটা জরুরি কাজের আগাম ফরমাশ দিয়ে রাখি:
১. বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন এই লেকের পাড়ে বসে বা দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগ করেন। গুলশানের দিকে লেকের পাড়ে কিছু গণশৌচাগার বানান, যাতে জনস্বাস্থ্যবিরোধী এই ন্যক্কারজনক দৃশ্য থেকে মুক্তি মেলে।
২. লেকের দুই পাড় সংযোগকারী তিনটি রাস্তাতেই লম্বা, একটু উঁচু এবং খানিকটা সুদৃশ্য সেতু রাখুন প্রকল্পে, যাতে এটা প্রকৃতই একটি লেকে পরিণত হয়। দক্ষিণের সেতুটি লেকটিকে হাতিরঝিলের সঙ্গে যুক্ত করবে। আপনি স্বপ্ন দেখছেন নাগরিকেরা এখানে নৌভ্রমণ করবে বিনোদনের জন্য, সে জন্যও এটা প্রয়োজন।
৩. বারিধারা পার্কের ভেতরে বেশ চওড়া ওয়াকওয়ে আছে। ওদিকে লোকজনও কম। পক্ষান্তরে গুলশান সাইডে সরু ভাঙাচোরা হাঁটাপথ। বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ এ পথ প্রতিদিন ব্যবহার করেন। লেকের পাড়টিতে চওড়া ওয়াকওয়ে তৈরি করুন। আমাদের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ যাঁরা সকাল–বিকেল হাঁটতে বেরোন, তাঁদেরও যাতে স্থান সংকুলান হয়।
৪. লেক পরিষ্কার হলে মাছ চাষ করবেন বলেছেন আপনি। দয়া করে এ কাজটি ভুলেও করবেন না। কিছু মাছের পোনা ছাড়ুন, শৌখিন শিকারিরা মাছ ধরুক। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষ করলে লেকের পানি আর গোসল করা বা নৌবিহারের যোগ্য থাকবে না।
৫. সবশেষে প্রকল্পে ব্যবস্থা রাখুন অন্তত দু–তিন বছর দিনরাত এক দল পাহারাদার রাখার, যাতে কেউ ময়লা ফেলতে এলে তাঁরা তেড়ে যেতে পারেন। বছর তিনেক এটা করতে পারলে আশা করি এলাকার বাসিন্দা এবং তাঁদের গৃহকর্মীরা উপলব্ধি করবেন যে লেক ময়লা ফেলার ভাগাড় নয়।
● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব