গত সপ্তাহে ‘কার ওপর ভরসা করছে বিএনপি’ শিরোনামে কলামটি প্রকাশের পর নানা মহল থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। কেউ কেউ এই কলাম নিয়ে ইউটিউবে পর্যালোচনাও করেছেন। একজন বিশ্লেষক বলেছেন, এই লেখায় পঞ্চদশ সংশোধনীর পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে। আবার কেউ বলেছেন, রাজপথে আন্দোলনে থাকা বিএনপির শক্তিকে খাটো করে দেখানো হয়েছে।
আমি বলতে চেয়েছি, নির্বাচনী সমস্যাটি পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব এর সমাধান চাইলে আইন বা সংবিধান বাধা হতে পারে না। নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পরও হয়নি।
নির্বাচন নিয়ে পাঁচ বছর পরপর যে ঝামেলা তৈরি হয়, সেটি কেবল নির্বাচনী সংকট নয়। মূল সমস্যা হলো গণতন্ত্রহীনতা। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনার যে প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় এসে সেটি অনেকাংশে ভুলে যায়।
তারা জনগণের শাসন কায়েম করার চেয়ে ‘আওয়ামী শাসন’ কিংবা ‘বিএনপির শাসন’ প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সবখানে নিজের লোক বসায় নির্বাচনী ফল নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য। নির্বাচন নিয়ে বর্তমানে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা ক্ষমতাসীনদেরই সৃষ্টি। বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে।
২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করার পর দুটি নির্বাচন হয়েছে—২০১৪ ও ২০১৮ সালে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে ২০১৪ সালে বিএনপি আসেনি বলেই ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্যরা জিতে গেছেন। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতারা কী ব্যাখ্যা দেবেন? সব দল অংশ নেওয়ার পরও জনগণের বড় অংশ ভোট দিতে পারল না? আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, নির্বাচনটি বিতর্কিত করার জন্য বিএনপি অংশ নিয়েছিল। তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। কথাটি কতভাগ সত্য? যদি তাদের সে রকম কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে সরকারের উচিত ছিল একজন বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা না করা। তঁাদের বাড়িতে তল্লাশি না চালানো।
আগে ও পরের পরিবেশের কথা যদি বাদও দিই, ভোটচিত্রের দিকে একবার আলোকপাত করা যাক। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০৩টি আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ওই সব কেন্দ্রে কি কোনো ভোটার মারা যাননি? ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৭ হাজার ৬৮৯টি কেন্দ্রে, ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১৫ হাজার ৭১৯টি কেন্দ্রে। বিপরীতে ১ হাজার ১৯৫টি কেন্দ্রে বিরোধী দল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী পেয়েছেন শূন্য ভোট। ভোটের এই পরিসংখ্যান কি প্রমাণ করে বিএনপি নির্বাচনটি বিতর্কিত করার জন্য অংশ নিয়েছিল?
২০১৮-এর নির্বাচন সম্পর্কে খোদ ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা (সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যটি স্মরণ করুন), জনপ্রশাসন ও পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা যেসব কথা মাঝেমধ্যে বলেন, সেগুলো কোনোভাবে সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। আসলে ২০১৮–এর নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর কেবল দেশবাসী নয়, আওয়ামী লীগের নেতারাও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। জঙ্গিদের হাতে নিহত লেখক হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকলে হয়তো লিখতেন, এই ভোট কি আমরা চেয়েছিলাম। বিএনপির আমলে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’
আওয়ামী লীগ নেতারা, সরকারের মন্ত্রীরা বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচন ২০১৮ ও ২০১৪-এর মতো হবে না। এর মাধ্যমে হয়তো আওয়ামী লীগ এটাই বোঝাতে চায়, তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায় না, একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনই তাদের কাম্য। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসাই হবে আওয়ামী লীগ বা সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দরকার, সেই পরিবেশ সেটা কি ক্ষমতাসীনেরা তৈরি করেছেন? করেননি। আওয়ামী লীগের নেতারা বলবেন, নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে, এমন নজির নেই। কিছুদিন আগেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে শুধু নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে তাঁরা ক্ষমতায় আসতে চান না। যদি তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষাই হবে দেশের এক নম্বর স্বার্থ। আর একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনেই সেটি সম্ভব। যদি গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়েই থাকে, তাহলে বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় কেন?
বিরোধী দল এখন সভা-সমাবেশ করতে পারছে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু বিএনপির কর্মসূচির দিন ক্ষমতাসীন দলটি কেন পাল্টা কর্মসূচি দেয়? কেন পুলিশকে বলতে হয়, ‘আপনারা এখান থেকে চলে যান। আওয়ামী লীগের মিছিল এসে আপনাদের ওপর চড়াও হতে পারে।’ এটা কি নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করা বা কর্মসূচি পালনের নমুনা?
এই যে প্রতিটি নির্বাচনের আগে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়, এ জন্য দেশের সাধারণ মানুষ, সংবাদমাধ্যম কিংবা আওয়ামী লীগ যাঁদের সকাল-বিকেল আঁতেল বলে গালমন্দ করে, তাঁরা দায়ী নন। রাজনীতিকদের সমস্যা হলো, তাঁরা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভাবেন। জনগণ যে তাঁদের কখনো ভোটে পরাজিত করতে পারে, সেটা মানতে চান না। কেউ পরাজিত হলে সূক্ষ্ম কারচুপি, কেউ স্থূল কারচুপির তত্ত্ব দেন।
কঠিন সত্য হলো, ক্ষমতাসীনদের অধীন নির্বাচন করে বাংলাদেশে কখনো বিরোধী দল জয়ী হতে পারেনি। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় থাকতে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়, যাতে ৩০০ আসনের মধ্যে ৯টি ছাড়া সব কটিতে ক্ষমতাসীনেরা পরাজিত হয়েছিল। সেই সময় ‘স্বাধীন নির্বাচন কমিশন’ বলে কোনো বস্তু ছিল না। ডিসি-এসপিরাই নির্বাচন পরিচালনা করতেন।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যেসব দেশের কূটনীতিকেরা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেন, তাঁদের ওপর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বেশ ক্ষুব্ধ। কিন্তু তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের (১২ জুন) রায় যখন বিএনপি মানছিল না, তখন ছয়জন বিদেশি কূটনীতিকই খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে নির্বাচনী ফল মানতে রাজি করিয়েছিলেন। কূটনীতিকদের সেই উদ্যোগ যদি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না হয়ে থাকে, আজ সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বলা হস্তক্ষেপ হবে কেন?
নির্বাচনের দিন যত কাছাকাছি আসছে, আওয়ামী লীগের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। এই অস্থিরতার কারণ বিএনপির ‘দেশবিরোধী তৎপরতা’ নয়, কারণ জনগণের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের বিচ্ছেদ। আইআরআইয়ের জরিপের ফলাফলে আওয়ামী লীগ নেতারা বেশ উল্লসিত। কিন্তু ওই জরিপই বলছে, বিরোধী দলের প্রতি ৫৩ শতাংশ মানুষের সমর্থন আছে।
গত ১৫ বছরে সরকার দেশের অনেক উন্নতি করেছে, পদ্মা সেতু-মেট্রোরেল মানুষের যোগাযোগকে সহজতর করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রে সূচকে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। সর্বত্র একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমরা যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আপত্তি করেছিলাম, সরকার আমলে নেয়নি। মন্ত্রীরা আইনটির পক্ষে নানা যুক্তি দেখাতে থাকলেন। সাড়ে চার বছর পর সেই আইনের অনেকগুলো ধারা সংশোধন করে সরকার নিজেদের ‘ভুল’ স্বীকার করে নিল। যে সরকার আইনের নামে জনগণকে ভয় দেখায়, সেই সরকার জনসমর্থন হারাতে বাধ্য।
মোদ্দা কথা হলো ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কারও ওপর ভরসা করতে হয়নি। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের মূল কথাই হলো বাছাই করার উন্মুক্ত সুযোগ, সেটাই যদি না হয় তাকে নির্বাচন বলা যায় না।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ‘অদৃশ্য শক্তির’ ওপর ভরসা করেছিল, যারা কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট, কোনো কেন্দ্রে শূন্যভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে। এবার যদি তারা ২০১৪ ও ২০১৮–এর মতো নির্বাচন না চায়, তাহলে জনগণের ওপরই ভরসা করতে হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে তাঁরা ক্ষমতায় আসতে চান না। যদি তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষাই হবে দেশের এক নম্বর স্বার্থ। আর একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনেই সেটি সম্ভব। যদি গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়েই থাকে, তাহলে বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় কেন?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি