খেলাটা মাঠের ভেতরে হলে ভালো হয় না? বিশ্বকাপের জন্য উড়ানের আগে-পরে দলের পারফরম্যান্স নিয়ে আলাপ নেই। আলাপের নমুনা ছিল, ‘ভিডিও বার্তায় তামিম: আমি এই নোংরামির মধ্যে থাকতে চাইনি’, ‘তামিম টিমম্যান কি না, এই প্রশ্নও তুললেন সাকিব’, ‘প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়ানো বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন ছিল না’, তামিমকে নিয়ে মাশরাফি’।
বাংলাদেশের জাতীয় দল নিয়ে শুধু যে দেশি পত্রিকায় এসব আলোচনা চলেছে, এমন নয়; ইএসপিএন লিখেছে, ‘সাকিব: তামিম চাইল্ডিশ, নট আ টিমম্যান’ (তামিম শিশুসুলভ, টিমম্যান না)। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) লিখেছে, ‘তামিম ইকবাল হিটস আউট অ্যাট বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আফটার সেইং হি অপ্টেড আউট অব ওয়ার্ল্ড কাপ’ (দল থেকে বাদ পড়েছেন জানিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতি ঝাল ঝাড়লেন তামিম)। ভারতের সংবাদপত্র টাইমস অব ইন্ডিয়া পেয়েছিল পেসার হাসান মাহমুদকে। তাঁর কাছেও প্রশ্ন ছিল তামিম ইকবালের বাদ পড়া নিয়ে।
আগামী ৫ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপের অন্য দল নিয়ে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে এমন মুখরোচক (?) লেখা চোখে পড়ল না। হালকা একটা প্রতিবেদন আছে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খাবারের মেনু নিয়ে। আর ইএসপিএন ক্রিক ইনফোতে ভারতে চোটের জন্য বাঁহাতি স্পিনার অক্ষর প্যাটেল বাদ পড়েছেন, তাঁর জায়গায় অফ স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন যুক্ত হয়েছেন—এ খবর আছে। তবে ওতে আমাদের মতো এত মসলা নেই।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল ও দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে আলোচনা এবারই প্রথম নয়; গত পাঁচ বছরের কথা ভাবুন। আমাদের জাতীয় দলের একসময়ের অধিনায়ক, তুমুল জনপ্রিয় মাশরাফি বিন মুর্তজা কথা নেই বার্তা নেই আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করে বসলেন। যে মানুষ এক সুতায় গোটা জাতিকে বাঁধতে পারতেন, তিনি আলোচনায় এলেন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে।
পাঁচ বছর পর জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে থাকেন। গরমকালে গরমের সবজি কেনেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে, মাছ-মাংসের দেখা পান না মাসের পর মাস, দুটো ডিম গোটা পরিবার ভাগ করে খান। তাঁদের কারও কারও জীবনে বিনোদনের একমাত্র অনুষঙ্গ এই ক্রিকেটই। তাঁদের ভালোবাসার সম্মানটা দিন। খেলাটা মাঠের বাইরে না খেলে অনুগ্রহ করে ভেতরে খেলুন, ভাইয়েরা।
জাতীয় দলের বর্তমান অধিনায়ক সাকিব আল হাসান খেলার বাইরে হাজারটা কারণে আলোচনায় এসেছেন। ‘৪ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারসাজির তদন্তে সাকিব আল হাসানের নাম’ (দ্য ডেইলি স্টার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২)। কোম্পানির নামের ক্ষেত্রে ভুয়া বাবার নাম ব্যবহার, জুয়াড়ির সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য গোপন করা, ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে দলের অফিশিয়াল ফটোসেশনে অংশ না নেওয়াসহ কত জাতের খবর যে বেরিয়েছে তাঁকে নিয়ে। একপক্ষের মত, বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ, সাকিব আল হাসান। আরেক দল বলে, না, না। তা কী করে হয়! তিনি জাতির রোল মডেল। তাঁর এসব করা সাজে না।
তর্কবিতর্কে পিছিয়ে ছিলেন না ক্রিকেটারদের পরিবারের লোকজনও। বছর দুয়েক আগে সাকিবের স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশির তাঁর ফেসবুকে লেখেন, ‘আমরা ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে একটু কথা বলতে পারি। আমি অবাক হচ্ছি, আমরা ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো বড় দলগুলোর বিপক্ষে কেন জিততে পারিনি, যখন আমাদের গতির তারকারা এবং কথিত সেরা উদ্বোধনী জুটি ছিল! কী ভুল হয়েছিল ওই ম্যাচগুলোতে, কৌতূহলী মন জানতে চায়? তখন আমরা যদি সেই ভুলগুলো নিয়ে টক শোতে আলোচনা করতাম, তাহলে আজ আমাদের এই ব্যর্থতা দেখতে হতো না।’
ওই বিশ্বকাপে অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি। এরপরই কারও নাম উল্লেখ না করে স্ট্যাটাস নিয়ে হাজির হন মাশরাফির ভাই মুরসালিন বিন মুর্তজা। তিনি লেখেন, ‘আমি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে আমাকে জানতে হবে যে সেই বিষয় নিয়ে কথা বলার মতো জ্ঞান আমার আছে কি না। হাত ঠেলার অভ্যাস সবারই থাকে, কিন্তু নিজের জ্ঞানের পরিসীমা বুঝে কথা বলার অভ্যাস সবার থাকে না।’
পারফরম্যান্স ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সরব হয়েছেন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর স্ত্রীরাও। এশিয়া কাপে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ দল থেকে বাদ পড়ায় তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল কাওসার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। ওই পোস্টে তিনি মাহমুদউল্লাহ কেন বাদ পড়েছেন, তার ব্যাখ্যা চান। লেখেন, ‘তাকে দলের প্রয়োজনে যখন যেখানে খুশি খেলতে নামানো হতো, তা–ও সে কখনো কোনো দিন কিছু বলেনি। তার স্বাচ্ছন্দ্যের পজিশন আসলে কোনটা? সেই সেক্রিফাইসগুলো না করলে আজকে তার রানের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতো।...আমার স্বামী খারাপ খেলে দল থেকে বাদ পড়েনি। ভালো করে পরিসংখ্যান অনুসন্ধান করলে দেখবেন, প্রাথমিক দলে থেকে কঠোর অনুশীলন করে চেষ্টা করেছে এবং ফিটনেস টেস্টেও ফেল করেনি। আলহামদুলিল্লাহ। তাই যথাযথ কারণ বিশ্লেষণ করে তাকে বাদ দিলে উপকৃত হতাম।’
গত বছরের ১৮ মে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে সেঞ্চুরি করে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ৫ হাজার রানের দেখা পান মুশফিক। দারুণ ওই পারফরম্যান্সের পর তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল মন্ডি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) খোঁচা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দেন। প্রতিবাদী স্ত্রীদের নিয়ে স্যাটেয়ার সাইট ‘ইয়ার্কি’ একটা মিম বানিয়ে ফেলেছে। আর মাঠের বাইরের আলোচনায় জাতীয় দলে জায়গা পাওয়া নবীন খেলোয়াড় তানজিম হাসান সাকিব এখন অনেককে পেছনে ফেলেছেন। জাতীয় সংগীতে গলা না মেলানো, কর্মজীবী নারীদের প্রতি কটাক্ষ, কট্টরপন্থী ধর্মীয় গুরুদের ভিডিও শেয়ার দেওয়াসহ অসংখ্য ইস্যু তাঁকে নিয়ে। এ নিয়ে কথা বলে ক্রিকেট অপারেশনসের জালাল ইউনুস আরও একদফা ট্রল হয়েছেন।
তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যে কেবল এবারই আলোচনায় এসেছে, তা নয়; দলের খারাপ পারফরম্যান্সের মধ্যেও ২০১৯ সালে দলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনের ক্যাসিনোয় যাওয়ার ছবিতে ফেসবুক ভেসে গিয়েছিল। আর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান যে মিমারদের কত প্রিয় চরিত্র, তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের খেলা মানেই তাঁকে নিয়ে ট্রল অবধারিত। দেশে কোন কোন ব্যক্তির অবস্থান অপরিবর্তনীয়, তাতে দুই নম্বরে আছেন তিনি। খেলা কথা নয়; এ রীতিমতো অবিস্মরণীয় অর্জন।
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ বড় হয়ে ওঠে—এ কথা প্রায়ই শোনা যায়। ক্রিকেটেও এর প্রভাব এখন অনেকটা স্পষ্ট। কয়দিন আগে তামিমের ‘অবসর–নাটকের’ বিষয়টা একবার ভাবুন তো! কেন তিনি আচমকা অবসরের ঘোষণা দিলেন, এ নিয়ে এখনো নানা আলোচনা–সমালোচনা বিরাজমান। তারচেয়েও যেটি চোখে পড়ার মতো, তা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি খেলায় ফিরে এসেছিলেন। এখন, কে খেলবেন বা কে খেলবেন না, তা যদি সরকারপ্রধানকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে এই ক্রিকেট থেকে আমরা কী আশা করতে পারি।
বাংলাদেশের এই জাতীয় ক্রিকেট দলটা একটা সময় প্রায় প্রতি ম্যাচে হারত। তবু দেশের মানুষ তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার পর জোর আলোচনা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট দল একদিন শ্রীলঙ্কার মতো কাপ জিতবে।
সাধারণ মানুষ অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনৎ জয়াসুরিয়া, চামিন্দা ভাস বা মুত্তিয়া মুরালিধরনের মধ্যে নিজের ছেলেদের খুঁজে পেতেন। একটা প্রজন্ম বড়ই হয়েছিল চোখে স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে। ২৬ বছর তো হয়ে গেল, স্বপ্নের মশালটাও কি তাঁরা তাঁদের সন্তানদের হাতে দিয়ে যেতে পারলেন? টেস্ট মর্যাদা পাওয়ারও তো ২৩ বছর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে আমাদের অর্জন কী!
পাঁচ বছর পর জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে থাকেন। গরমকালে গরমের সবজি কেনেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে, মাছ-মাংসের দেখা পান না মাসের পর মাস, দুটো ডিম গোটা পরিবার ভাগ করে খান।
তাঁদের কারও কারও জীবনে বিনোদনের একমাত্র অনুষঙ্গ এই ক্রিকেটই। জাতীয় দল যখন বিদেশের মাটিতে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলা মেলায়, তখন সুরে-বেসুরে তাঁরাও তাঁদের গলা মেলান। গেঞ্জির খুঁট, শাড়ির আঁচল বা ওড়না দিয়ে চোখের জল মোছেন। তাঁদের ভালোবাসার সম্মানটা দিন। খেলাটা মাঠের বাইরে না খেলে অনুগ্রহ করে ভেতরে খেলুন, ভাইয়েরা।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল [email protected]