অতি উৎসাহীরা তো প্রশ্ন তুলতেই পারেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে পেশাদার সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে তাঁরা তো ‘দেখেই’ ফেলেছেন অধিকাংশ খবরাখবর! তাহলে বাংলাদেশে হাজারখানেক সংবাদমাধ্যমের উপযোগিতা কতখানি?
মূলধারা ও সামাজিক মাধ্যমে অধিক আলোচিত-সমালোচিত, বিশেষ করে অতি প্রভাবশালীরা দ্রুতই বিরক্তি বা ক্রোধ প্রকাশ করেন উভয় মাধ্যমের প্রতি।
সেদিক থেকে ক্ষমতাসীন ও বিত্তশালীদের একটি অংশ ভাবতে পারে, সংবাদমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেলে তা তাদের জন্য মঙ্গলজনক। সুতরাং বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে গণমাধ্যমের সংকট নিয়ে যে কান্নাকাটি এবং ক্ষেত্রভেদে মায়াকান্না ও ন্যাকামি, তা কারও কারও কাছে সুখকরই বটে। আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন সাংবাদিকতার আলোচনাটি সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেড়াজালেই বেশি আটকা পড়েছে।
নিবর্তনমূলক এ আইনের জন্যই যে কেবল ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, বাস্তবতা সে রকম নয়। সাংবাদিক হত্যার বিচারহীনতা ও সাংবাদিকতার জন্য মামলা-হামলার হুমকি অনেককেই সন্ত্রস্ত রাখে। রাজনৈতিক পরিসর সংকুচিত হওয়ার অভিযোগের মধ্যেই গণমাধ্যমের কর্ণধারেরা আয়রোজগারের সংকটে পড়েছেন এবং তাঁরা মোটাদাগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অভিসম্পাত করছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পেশা ও শিল্পের লোকদের এই হতাশাজনক কথাবার্তা এক দিকে স্বপরাজিত অভিব্যক্তি তৈরি করছে, অন্য দিকে ক্ষমতাসীনদের জন্য স্বস্তিদায়কও বটে।
আজকের পৃথিবীতে সমাজের স্বার্থে আমাদের সাংবাদিকতার ধারায় পরিবর্তন আনা জরুরি। কোনো খবরের কাগজ বা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে পাঠক-দর্শকের সরে যাওয়া কিংবা সামাজিক মাধ্যমে বার্তা খুঁজে বেড়ানো খবরের চাহিদাই প্রমাণ করে। না ক্ষমতা, না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিতে পারে নাগরিকদের ভালো লাগার খবর। স্পন্দনশীল গণমাধ্যম ছাড়া গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গড়া অসম্ভব। সাংবাদিকতাও টেকসই হতে পারে, যদি তা হয় মানুষের মালিকানায়, মানুষের কর্মে, মানুষের কল্যাণে।
রয়টার্সসহ কিছু সংবাদমাধ্যম ও পশ্চিমা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষ তার কণ্ঠস্বর গণমাধ্যমে শুনতে পায় না। ক্ষমতার পূজারি আর সুবিধাভোগীদের দৌরাত্ম্যে সংবাদমাধ্যমে যা কিছু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তার একটি বড় অংশই অসত্য, বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর। এতে আস্থার সংকট প্রকট হয়েছে এবং হচ্ছে।
এটিই হচ্ছে সেই ‘দুষ্টচক্র’, যা বাংলাদেশেও গণমাধ্যমের সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। সমাজে যা ঘটছে, দিনান্তে পাঠক-শ্রোতা তার আসলটা না পেয়ে প্রথাগত গণমাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে সংবাদমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতার অভাব তৈরি হয়েছে এবং সমাজে প্রভাব কমে এসেছে। এতে বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য আয়ে ধস নামছে। ফলে একটির পর একটি সংবাদমাধ্যম অস্তিত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছে।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অন্তত আর্থিক ও প্রযুক্তিগতভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে আছে শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমগুলো। বাংলাদেশে দু-চারটি বিবেকবান গোষ্ঠী বাদে সামাজিক পরিসর, এমনকি শিক্ষাঙ্গন থেকে ক্ষুরধার সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিন্তাশীল বক্তব্য আসছে না বললেই চলে।
তাহলে কয়েক হাজার সাংবাদিক ও সংবাদশিল্পের কর্মীকে অন্যত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিলে কেমন হয়? জাতি তখন মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের বদলে গণমাধ্যমমুক্ত দিবস পালন করতে পারবে!
আব্রাহাম লিংকনের মতো আদর্শ গণতান্ত্রিক শাসক ছাড়া যেকোনো ক্ষমতাসীনের আজীবনের স্বপ্ন হতে পারে সমালোচনাবিহীন রাষ্ট্রীয় পরিবেশ। আধুনিক কালে তাঁদের সমালোচনাও সংকুচিত করার সুযোগ করে দিয়েছে প্রযুক্তিগত নেটওয়ার্কিং। প্রযুক্তির জগতে সাধারণ নাগরিকেরা আসলে গ্রাহকমাত্র। এ বিষয়ে দ্য ইকোনমিস্ট ইউভাল নোয়াহ হারারিকে উদ্ধৃত করেছে: কারও সঙ্গে কথোপকথনে আমি যদি বলতে না পারি, তিনি মানুষ নাকি ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’, তাহলে সেটাই গণতন্ত্রের সমাপ্তি।
যে সামাজিক মাধ্যমকে মনে করা হচ্ছিল ব্যক্তির মুক্তির মাধ্যম, তা শুধু শাস্তিমূলক নজরদারিতেই ব্যবহৃত হচ্ছে না, বরং সত্যকে লুকিয়ে অসত্য, বিকৃত, খণ্ডিত ও মনগড়া তথ্য ছড়াতে তা ব্যবহার করছেন অধিক ক্ষমতাবানেরা। যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে চটকদার খবরের স্বাদ নিচ্ছেন, তাঁরাই আবার প্রধান গণমাধ্যমে ফিরছেন সত্যতা যাচাই করতে। দেশে দৃশ্যত প্রশংসার স্বাধীনতা একটু বেশিই আছে। এ কারণেই হয়তো ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরাও ‘মিডিয়া কাভারেজ’-এর বাইরে থাকতে চান না।
আমাদের ক্ষেত্রে কেউ কেউ ক্ষমতাসীনদের তোষণনীতি এমন এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে তাতে সংবাদমাধ্যম শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। প্রায় সবাই জানেন, বছরের পর বছর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কোন বার্তা দেয়। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আর এখনো টিকে থাকা সরব পত্রিকা বা অন্য সংবাদমাধ্যম বিজ্ঞাপন বঞ্চনার শিকার হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে এ দেশে আজ অধিকাংশ মিডিয়া প্রাকৃতিক মৃত্যুর অপেক্ষায়।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা জনগণের অধিকার। দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশে এই শিল্পের সংকটকালে ক্ষমতাধরদের যৎকিঞ্চিৎ সমালোচনাকেও শত্রুর দৃষ্টিতে দেখা হয়। যেহেতু আদর্শিকভাবে সংবাদমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত মানুষের বন্ধু; সেহেতু যে আমলা ও রাজনীতিক ক্ষমতার চেয়ারে বসা অবস্থায় গণমাধ্যমকে শাপশাপান্ত করেন, সেই আমলা বা রাজনীতিকই ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার পর পরিত্রাণ পেতে ও সহানুভূতির আশায় সংবাদমাধ্যমের শরণাপন্ন হন।
গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় রাজনীতির পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা প্রধানতম। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক বণ্টন ও ব্যক্তি খাতের অগ্রগতিতে গণমাধ্যম গণমানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল নব্বই ও পরবর্তী দশকে। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমের ক্রমাবনতিশীল অবস্থা আর দুর্নীতির বিস্তার, ভীতির পরিবেশ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, আর্থিক কেলেঙ্কারি ও ভোট সংস্কৃতির সর্বনাশ ঘটেছে সমান্তরালে।
বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত বিবেক ও বাক্স্বাধীনতা ভোগ করতে বড় বাধা মুক্ত ও টেকসই প্রতিষ্ঠানের অভাব। একজন ব্যক্তি ভালো প্রতিবেদন লিখতে পারলেও প্রকাশ করতে না পারলে, তা অর্থহীন। সে কারণেই আধুনিক গণতান্ত্রিক সভ্যতা স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া অকার্যকর। গণতন্ত্রবিহীন পরিবেশে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অপ্রাসঙ্গিক। একজন সাংবাদিকের সাহস থাকা দরকার নিরন্তর সংগ্রামের, আত্মসমালোচনার।
আসলে সাংবাদিকতা একটি রাজনৈতিক পেশা, কিন্তু দলীয় কর্মী বা অন্য কারও দালালির কাজ নয় এটি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের কর্মযজ্ঞ একটি আমানত, যা সৎ সাংবাদিককে প্রমাণ করতে হয় প্রতিদিন। জনগণের কাছে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে যোগ্যতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার বিকল্প এখনো বের হয়নি।
আজকের পৃথিবীতে সমাজের স্বার্থে আমাদের সাংবাদিকতার ধারায় পরিবর্তন আনা জরুরি। কোনো খবরের কাগজ বা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে পাঠক-দর্শকের সরে যাওয়া কিংবা সামাজিক মাধ্যমে বার্তা খুঁজে বেড়ানো খবরের চাহিদাই প্রমাণ করে। না ক্ষমতা, না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিতে পারে নাগরিকদের ভালো লাগার খবর। স্পন্দনশীল গণমাধ্যম ছাড়া গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গড়া অসম্ভব। সাংবাদিকতাও টেকসই হতে পারে, যদি তা হয় মানুষের মালিকানায়, মানুষের কর্মে, মানুষের কল্যাণে।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক, মতামত লেখক।