মিয়ানমারের নর্দান শান ও রাখাইন রাজ্যে গত বছর ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ১০২৭ অভিযান শুরুর কিছুদিন পরই লড়াই বন্ধের জন্য চাপ দিতে শুরু করে চীন।
এই চাপ সত্ত্বেও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) ও আরাকান আর্মি (এএ) যৌথ আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। তাদের অব্যাহত হামলায় জান্তা সরকার বিরাট একটা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
গত ডিসেম্বর মাসে চীন প্রথমবারের মতো জান্তা সরকার ও ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করে। সে সময় বেইজিং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে লড়াই বন্ধের জন্য চাপ দেয়।
সংলাপে মিয়ানমারের বিষয়ে চীনের বিশেষ দূত নেং সি সান, জান্তা সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিদল এবং এমএনডিএএ ও টিএনএলএর সাধারণ সম্পাদক ও আরাকান আর্মির ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ অংশ নেয়।
জানুয়ারির মাঝামাঝি চীনের কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত তৃতীয় দফা সংলাপে দুই পক্ষ অস্ত্রবিরতির বিষয়ে সম্মত হয়। যদিও এই চুক্তির পরিধি চীনের সীমান্তবর্তী নর্দান শান স্টেটেই সীমাবদ্ধ।
এই অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার আগেই এমএনডিএএ শান স্টেটের বিশাল ভূখণ্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা সেখানে নিজেদের প্রশাসন চালু করে, যার নাম কোকাং স্বশাসিত অঞ্চল। টিএনএলএ-ও তারা যে পালং স্টেট প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, সেখানে বিশাল ভূখণ্ডের দখল নিয়ে নিয়েছিল।
এমএনডিএএ, টিএনএলএ দুটো সশস্ত্র গোষ্ঠীরই একটা যুদ্ধবিরতি দরকার, যাতে তারা তাদের জয় করে নেওয়া এলাকায় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এ দুটি গোষ্ঠী এ কারণেই অস্ত্রবিরতিতে সমর্থন দিয়েছে, যাতে নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় জান্তা সরকারের বাহিনী বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ না করে।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের চীনের দিক থেকে আসা চাপে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সে কারণেও তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
রাখাইনে কোনো অস্ত্রবিরতি চুক্তি হয়নি
নর্দান শান স্টেটেই এই অস্ত্রবিরতি চুক্তি সীমাবদ্ধ। পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান সংঘাত এর আওতাধীন নয়। জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে যখন অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, সে সময় আরাকান আর্মি কেবল রাখাইনের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী চিন স্টেটের প্রবেশদ্বার পালাতোয়ার অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণ করছিল। সে কারণে দুই পক্ষের কেউই রাখাইনের অস্ত্রবিরতি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন বলে মনে করেনি।
দুই মাস পর আরাকান স্টেট এখন পালাতোয়ার সঙ্গে কায়াকটাও, মারাক-উ, মিনবিয়া, পাকতাও, ময়িকন ও পনাগিয়ান শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।
ব্রাদারহুড জোটের সঙ্গে সামরিক সরকারের চতুর্থ দফা সংলাপ হয়েছে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ। সেই আলোচনার সময় আরাকান আর্মি অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব নাকচ করে। আরাকান আর্মি আবারও নিশ্চিত করে যে তারা পুরো রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়।
আরাকান আর্মি তাদের বাহিনীর মূল অংশটা রাখাইনে নিয়োজিত করলেও তারা তাদের সেনাদের অন্য অংশকে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রন্টে নিয়োজিত করেছে। নর্দান শান স্টেটে এমএনডিএও ও টিএনএলএ-র সঙ্গে এবং কাচিন ও শান স্টেটে পিপলসস ডিফেন্স ফোর্স ও কাচিন ইনডিপেন্ডস আর্মির সঙ্গে একসঙ্গে মিলে যুদ্ধ করছে আরাকান আর্মি। নর্দাস শান স্টেটের বাইরে অন্য কোথাও অস্ত্রবিরতির আওতায় নেই আরাকান আর্মি।
গত সংলাপের উদ্দেশ্য ছিল, নর্দান শান স্টেটের অস্ত্রবিরতি আরও কার্যকর করা এবং লড়াইয়ের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া চীন-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য আবার চালু করা। এই সংলাপে দুই পক্ষই সীমান্ত বাণিজ্য চালুর ব্যাপারে সম্মত হয়, কিন্তু বাণিজ্যপথে সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। মিয়ানমারের জান্তা সরকার বারবার সীমান্ত বাণিজ্যের পথ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে ব্রাদারহুড জোটকে অনুরোধ করে। কিন্তু, জাতিগোষ্ঠীর জোটের সঙ্গতকারণেই তাদের অধিকৃত ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা নেই।
১৩০ দিনের বেশি সময় চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। চীন চায়, বাণিজ্য যেন যত দ্রুত সম্ভব চালু হয়। দুই পক্ষই মে মাসে পরবর্তী মীমাংসায় বসার জন্য দিন ঠিক করেছে।
গত সংলাপে সেনা নামানো ও নর্দান শান স্টেটের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু চলমান অস্ত্রবিরতি বজায় রাখা এবং মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগের সুরক্ষা দেওয়া ছাড়া আর কোনো আলোচনা হয়নি।
চীন মনে করে যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিপ্লবীদের মধ্যে লড়াইয়ে কেউ জিততে পারবে না। সে কারণে সমঝোতার ভিত্তিতে এই লড়াইয়ের সমাপ্তি হওয়া প্রয়োজন। যদিও যত দিন গড়াচ্ছে, ততই জান্তা সরকার দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু, তাদের যে খুব শিগগির পতন হবে, সেটা মনে করে না চীন।
চীনের স্বার্থ
মিয়ানমারে চীনের কর্মপন্থা তাদের নিজেদের স্বার্থ দিয়ে পরিচালিত হয়। প্রথমত, রাখাইন থেকে নর্দান শান স্টেট পর্যন্ত গ্যাস ও তেলের পাইপলাইনও রয়েছে। এ সরবরাহ কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হলে চীনের ব্যবসার ওপর তার বড় প্রভাব পড়বে।
দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তপথে চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ পাঁচ বিলিয়ন ডলার। বেইজিং যেকোনো মূল্যে এই ব্যবসা চালু রাখতে চায়। তৃতীয়ত, চীন রাখাইনে যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করেছে, তা তাদের বৈশ্বিক বেল্ট অ্যান্ড রোডস উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
চীন মনে করে যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিপ্লবীদের মধ্যে লড়াইয়ে কেউ জিততে পারবে না। সে কারণে সমঝোতার ভিত্তিতে এই লড়াইয়ের সমাপ্তি হওয়া প্রয়োজন। যদিও যত দিন গড়াচ্ছে, ততই জান্তা সরকার দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু, তাদের যে খুব শিগগির পতন হবে, সেটা মনে করে না চীন।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোও একই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। প্রতিবেশী দেশগুলো সীমান্তে অস্থিতিশীলতা চায় না। তারা মনে করে, এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি একদিকে যেমন বাণিজ্যের ক্ষতি করে, তেমনি বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।
এ কারণেই আঞ্চলিক দেশগুলো চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও বিপ্লবীদের মধ্যকার সংলাপকে নীরবে সমর্থন দিচ্ছে। জান্তাপ্রধান বারবার বলে আসছে যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ তারা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। কিন্তু যখন শক্তিশালী প্রতিবেশী চীনের হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ আসে, তখন তারা কথা বলতে ভয় পায়।
এ প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের বিপ্লবী শক্তিকে চীনের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো কিংবা বিরোধিতা করার বদলে কীভাবে মানিয়ে চলতে হবে, তার জন্য ঠিক পথটা খুঁজে বের করতে হবে। চলমান পরিস্থিতিকে তাদের নিজেদের অনুকূলে কীভাবে আনা যাবে, সেটা শিখতে হবে। মিয়ানমারে যে সংকট বাড়ছে, সেটা নিছক সামরিক বিষয় নয়। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিষয়ও।
থেট তার মাং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দ্য ইরাবতী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মনোজ দে