বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বাভাবিকভাবেই অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, সংখ্যালঘুর গৃহ আক্রান্ত হয়েছে, পুরোনো শত্রুতাবশত প্রতিহিংসামূলক ঘটনাও ঘটেছে। এসব অনভিপ্রেত হলেও অভাবিত নয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থিতু হয়ে বসলে, আইনশৃঙ্খলা অবস্থা নিয়ন্ত্রণের ভেতরে চলে এলে অবস্থা পরিবর্তিত হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
কিন্তু ভয় অন্যত্র। চলতি সরকার, হোক না তা অন্তর্বর্তীকালীন, তার গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ যদি দেশের-জাতির-মোদ্দা চরিত্রে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা উদ্বেগের জন্ম দেবে। এই রকম একটি সিদ্ধান্ত, ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসের ছুটি বাতিল। এ কথা ঠিক শোক দিবসের ছুটির সিদ্ধান্ত দলীয় ছিল, কিন্তু শোক দিবস পালন প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষ খুব যে দ্বিধাবিভক্তি ছিল, আমার তা মনে হয় না।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন, তা আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী ছিল, কিন্তু তা বঙ্গবন্ধু বা বৃহত্তর অর্থে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর ঠিক সে কারণেই ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন না করা বা এই দিন সরকারি ছুটি বাতিল, উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
এ কথা ঠিক, বহিষ্কৃত হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় শ্রদ্ধার পাত্র থেকে জাতীয় পরিহাসে পরিণত করে ফেলে। নতুন প্রায়-প্রতিটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা বঙ্গবন্ধুর নামে উৎসর্গ করা, অথবা টেলিভিশনে নিরন্তর বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা আমরা যারা বিগত প্রজন্মের সদস্য তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও নতুন প্রজন্মের, যাদের ‘জেন–জি’ নামে ডাকা হচ্ছে, তাদের কাছে বিদ্রূপে পরিণত হয়েছিল। অনুমান করি, ৫ আগস্টের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্থাপত্যের ওপর হামলার ঘটনা মূলত এই সমীকরণ থেকেই উদ্ভূত।
অপরাধটা বঙ্গবন্ধুর নয়, যাঁরা জাতির পিতাকে নিজেদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য এমন হাসির পাত্রে পরিণত করে ফেলেছিলেন, তাঁদের। কিন্তু অস্বীকার করি কী করে, তিনিই আমাদের জাতির পিতা, তিনিই আমাদের স্বাধীনতার ও সংগ্রামের প্রতীক।
১৫ আগস্টকে সরকারি ছুটি ঘোষণা হয়তো একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, কিন্তু এই দিবসটি জাতীয়ভাবে উদ্যাপনের মাধ্যমে বাঙালি কেবল তার জনককেই স্মরণ করে না, তার স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। ঠিক সে কারণে, নির্বাহী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল ঘোষণা ও সরকারি আয়োজন ছাঁটাই আমার কাছে অসম্মানজনক মনে হয়েছে।
আমাদের কোনো বক্তব্য বা সিদ্ধান্ত যাতে সে প্রচারে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে টিকে থাকার এক লড়াইতে লিপ্ত। হাসিনা সরকার পরাস্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টা সে করবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তারা যদি প্রতিবিপ্লবের কোনো গোপন চক্রান্ত ফাঁদতে চায়, তা যে ভারতের মাটিতে ও তার সমর্থনপুষ্ট হয়েই হবে, তা ভাবা একদম অযৌক্তিক নয়। এ কারণে ভারতের প্রশ্নে আমাদের সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
দ্বিতীয় উদ্বেগ, প্রতিবেশী ভারতের প্রতি অকূটনৈতিকসুলভ বক্তব্য। রাজনৈতিক বা নাগরিক পর্যায়ে এসব বক্তব্য সীমিত থাকলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু থাকত না, কিন্তু চলতি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের মুখেও সমালোচনামূলক বক্তব্য শোনা গেছে। এসব বক্তব্য ব্যবহার করে—কখনো কখনো তা বিকৃতভাবে পরিবেশন করে—ভারতীয় তথ্যমাধ্যমে খোলামেলাভাবেই বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু হয়েছে। ভারতের কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা সেসব সমালোচনা ও বিরুদ্ধ প্রচারে গলা মেলাচ্ছেন।
আমাদের কোনো বক্তব্য বা সিদ্ধান্ত যাতে সে প্রচারে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে টিকে থাকার এক লড়াইতে লিপ্ত। হাসিনা সরকার পরাস্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টা সে করবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তারা যদি প্রতিবিপ্লবের কোনো গোপন চক্রান্ত ফাঁদতে চায়, তা যে ভারতের মাটিতে ও তার সমর্থনপুষ্ট হয়েই হবে, তা ভাবা একদম অযৌক্তিক নয়। এ কারণে ভারতের প্রশ্নে আমাদের সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ভয়ের আরেক কারণ, হাসিনা সরকারের পতন হতে না হতেই ধর্মীয় রাজনীতিকদের মঞ্চে পুনরাবির্ভাব। ধর্মকে পুঁজি করে যেসব দল রাজনীতি করে, তারা ঠিক কখনোই মাঠ ছেড়ে চলে যায়নি, শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে সুযোগ এখন দ্বারপ্রান্তে, ফলে তাদের প্রকাশ্যে আসার আর কোনো বাধা নেই।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার কথা মুখে যত বলা হয়েছে, কাজে-কলমে তা করে দেখানো ততটা নয়। বস্তুত ঘটেছে উল্টো। ধর্মীয় রাজনীতিকদের স্পষ্ট চাপে পাঠ্যপুস্তকের ধর্মীয়করণ ঘটেছে। মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে এবং এমনকি সে শিক্ষাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের বলে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক আবহ লালিত নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন বোলচালে ধর্মীয় সংস্কৃতিতে অত্যন্ত পারদর্শী।
চলতি আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ কেউ খোলামেলাভাবেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি চালুর পক্ষে। কেউ নারী স্বাধীনতাবিরোধী, পর্দাপ্রথার সমর্থক এবং তৃতীয় লিঙ্গের কোনো অধিকার আমলে আনতে নারাজ।
এই ধর্মবিশ্বাস যদি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে, তাতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। এই ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও ধর্মাচার রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত হলে বিপদ ঘটবে। লক্ষ করেছি, কেউ কেউ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার দাবি তুলেছেন। কারণ, তাঁদের দাবি বেগম রোকেয়ার অনেক লেখায় ইসলামবিরুদ্ধ বক্তব্য রয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম খালিদ হোসেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি বিভিন্ন বক্তব্যে চলতি শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পক্ষপাতী বলে মত দিয়েছেন। ধর্মীয় শিক্ষা, তাঁর বিবেচনায় একটি সাংবিধানিক অধিকার। তিনি প্রাথমিক থেকে এমএ পর্যন্ত ‘ইসলামি তালিম’ অন্তর্ভুক্ত করতে চান। বিভিন্ন ভিডিওতে তিনি আরও এমন অনেক বক্তব্য দিয়েছেন, যা আমার কাছে উদ্বেগজনক মনে হয়েছে। তাঁর এ অবস্থান সরকারের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বিপ্লব ভালো। আরও ভালো বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন। কিন্তু এই অর্জনের মূল্য যদি হয় ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় নীতির প্রবর্তন ও ব্যক্তিগত অধিকার হরণ, তাহলে সে বিপ্লবের যৌক্তিকতা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক