গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের অভূতপূর্ব ও অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা ও তিক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
এরপর সমস্বরে সব স্তরের পুলিশ সদস্যরা একটি দাবি তুলেছিলেন। তা হলো, পুলিশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চায়।
পুলিশ কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের আর তাঁবেদারি করতে চায় না। বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত ২ লাখ ১২ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে ভিন্ন মত-পথ থাকলেও এই ইস্যুতে তাঁরা সবাই একমত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই রাষ্ট্রের বাহিনী হিসেবে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান।
৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে পুলিশের সংস্কার নিয়ে ইউনিট পর্যায় থেকে আসা বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের প্রায় শতভাগ ইউনিটের প্রধান দাবি বা প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশ পুলিশকে পরিচালনার জন্য স্বাধীন একটি কমিশন গঠন করা হোক।
বাংলাদেশ পুলিশের সব পর্যায়ের সব স্তরের পুলিশ সদস্যরা কেন এমন দাবি তুলেছিলেন, তার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, পতিত স্বৈরাচার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। বাধ্য হয়ে তাঁদের অনেকেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাঁরা জনরোষের শিকার হয়েছেন (ঢাকা পোস্ট, ১৭ নভেম্বর ২০২৪)।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত যে পতিত সরকার আইনকে তোয়াক্কা না করে পুলিশকে তাদের কর্মীর মতো ব্যবহৃত হতে বাধ্য করেছে। ফলে এই আন্দোলনে কমপক্ষে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য হত্যার শিকার হয়েছেন (প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট ২০২৪)।
থানা, পুলিশ অফিস, পুলিশ লাইনসসহ অন্তত ৪৬০টি পুলিশ অবকাঠামো এবং পুলিশের ১ হাজার ৭৪টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (বার্তা বাজার, ১ ডিসেম্বর ২০২৪)।
২০২৪–এর পয়লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া কোটা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেওয়ার এই ৩৬ দিনের জার্নিতে বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো মাঠে থেকে কাজ করেছে।
কিন্তু এককভাবে পুলিশ সদস্য, পুলিশ স্থাপনা ও পুলিশের যানবাহনকে টার্গেট করে আক্রমণ করা নিশ্চিতভাবেই পুলিশের প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ কিংবা পুলিশের নেতিবাচক ভূমিকার প্রতি মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু প্রশ্নটি হলো, এটি কেন হলো? আইনানুযায়ী পুলিশের প্রতিটি পদক্ষেপ আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত ও লিখিত হওয়ার কথা।
এ ছাড়া বিদ্যমান সরকারি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে পুলিশ সরকারের অধীনে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানমাত্র।
তাহলে প্রশ্ন হলো, বিদ্যমান আইন, বিধি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো থাকার পরও পুলিশ কীভাবে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহৃত হলো বা হতে বাধ্য হলো?
কেন পুলিশ এই নির্দেশের বাইরে যেতে পারেনি?
কার ভুলে পুলিশ সদস্যরা জীবন হারালেন?
কেন আজও পুলিশ মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে জনরোষের শিকার হচ্ছেন?
পুলিশের ওপর এমন অকল্পনীয় ঝড় বয়ে যাওয়ার পর কেন পুলিশ সদস্যরা সমস্বরে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের দাবি জানালেন?
সত্যিকার অর্থেই যদি বাংলাদেশ পুলিশকে জনগণের পুলিশ কিংবা এই রাষ্ট্রের পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, অতীতের এসব ভুলের কারণ ও এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
১৮২৯ সালে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট পাস হয়। অন্যদিকে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের অবসান হলে সরাসরি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে যাওয়ার পর ১৮৬১ সালে পুলিশ অ্যাক্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়, যা বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ ওই সময়ের ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা উপমহাদেশের সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হয়।
আপনি যদি এই দুটি আইনের প্রথম পাঠকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া এই দুটি পুলিশ আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
যেখানে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী, পুলিশকে জনগণের আস্থা অর্জনের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য পাস করা পুলিশ অ্যাক্ট–১৮৬১–এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখা।
আরও অবাক করা বিষয় হলো, সময়ের সঙ্গে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্টকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন, আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে আমাদের বিদ্যমান পুলিশ অ্যাক্টকে পাকিস্তান আমলে কিছু নাম আর টার্মকে পরিবর্তন করেছি, আরেকবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কিছু নাম আর টার্মকে পরিবর্তন করেছি।
এর বাইরে আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি দেখবেন, তা হলো ব্রিটিশ আমলে ইন্সপেক্টর জেনারেলকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, যা পর্যায়ক্রমিকভাবে সংকুচিত করে দেওয়া হয়েছে।
অথচ মানুষ পুলিশের কাজকে সরকারি কাজ হিসেবে বিবেচনা না করে বরং পুরো ক্ষোভটাই পুলিশের ওপর ঝাড়ল। নিহত হলেন, আহত হলেন অসহায় পুলিশ সদস্যরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। সত্যিকার অর্থে, স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও পুলিশ আইন সংস্কার করার দাবির মাধ্যমে পুলিশ যেকোনো কর্তৃপক্ষের অবৈধ, অন্যায় ও বেআইনি হুকুমকে জোরালোভাবে ‘না’ বলার সুযোগ চায়।
আরও সহজ করে বললে ব্রিটিশ আমলের করা আইনে ইন্সপেক্টর জেনারেল যেসব বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, সময়ের সঙ্গে তাঁর ক্ষমতাকে সংকুচিত করে পুরোপুরি সরকারের আজ্ঞাবহ করে ফেলা হয়েছে।
আরও মজার বিষয় হলো, রাস্তায় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের (জন উপদ্রব বা পাবলিক নুইসেন্স) জন্য পুলিশ আইনানুযায়ী অনূর্ধ্ব ৫০ টাকার জরিমানা করার বিধানটি এখনো বহাল আছে (দেখুন পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১–এর ৩৪ ধারা)!
গত জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন।
প্রশ্ন তোলার মতো যথেষ্ট কারণও আছে। কিন্তু এখন যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, বিদ্যমান আইনে সরকারি সিদ্ধান্তকে মান্য না করার জন্য পুলিশের কি আইনি সুযোগ বা সুরক্ষা আছে?
পুলিশ আইন ১৮৬১–এর ২৩ ধারা অনুযায়ী, ‘প্রত্যেক পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হইবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত সকল বৈধ আদেশ ও পরোয়ানা দ্রুত পালন ও কার্যকর করা।’
অথচ এই আইনের কোথাও আপনি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত আদেশের বৈধতা বা অবৈধতা নিরূপণ বা চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই।
এমনকি অবৈধ আদেশ না মানার সুযোগ বা এ–সংক্রান্ত কোনো আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। কাজেই বিদ্যমান আইনে পুলিশ সরকারের হুকুম মানতে বাধ্য।
এ কারণেই গত জুলাই আন্দোলনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারের নির্দেশনা মেনেই পুলিশকে বল প্রয়োগ করতে হয়েছে।
আপনি হয়তো আমার সঙ্গে দ্বিমত হতে পারেন, তবে বিদ্যমান আইনানুযায়ী এর বিকল্প কিছু করার সুযোগ কি পুলিশের ছিল বা আছে?
পুলিশ যদি সরকারের আদেশ না মানত, তাহলে সেটি কি পুলিশ আইনের লঙ্ঘন হতো না?
অথচ মানুষ পুলিশের কাজকে সরকারি কাজ হিসেবে বিবেচনা না করে বরং পুরো ক্ষোভটাই পুলিশের ওপর ঝাড়ল। নিহত হলেন, আহত হলেন অসহায় পুলিশ সদস্যরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে।
সত্যিকার অর্থে, স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও পুলিশ আইন সংস্কার করার দাবির মাধ্যমে পুলিশ যেকোনো কর্তৃপক্ষের অবৈধ, অন্যায় ও বেআইনি হুকুমকে জোরালোভাবে ‘না’ বলার সুযোগ চায়।
রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে বিদ্যমান আইনানুযায়ী দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়।
যেখানে যেকোনো রাজনৈতিক শক্তি তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করতে পারবে না।
পুলিশ এমন একটি ব্যবস্থা চায়, যেখানে জবাবদিহির আওতায় থেকেই বাংলাদেশ পুলিশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
বাংলাদেশ পুলিশের এই চাওয়া কি খুব বেশি অযৌক্তিক? এটি কি গণমানুষের চাওয়া নয়? আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে এর বিকল্প আছে কি?
মো. ইমরান আহম্মেদ পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ এবং বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক, যুক্তরাজ্য।
ই–মেইল: emranahmmed1991@gmail.com