বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে যেভাবে ঢেলে সাজানো যায়

বাংলাদেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো দেশের ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা–চাহিদা পূরণে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। গ্রাম থেকে শহর—সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

তবে এই খাতের সম্ভাবনা ও প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং নৈতিক মান নিয়ে দীর্ঘদিনের সমস্যা এটিকে জর্জরিত করে রেখেছে। অনিয়ম, অতিরিক্ত মুনাফার লোভ, দালালনির্ভরতা এবং রোগীদের প্রতি অবহেলার মতো ঘটনা প্রায়ই শিরোনামে উঠে আসে।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনস্বার্থের সঙ্গে সমন্বয় করতে সরকারকে একটি বিস্তৃত, সুচিন্তিত এবং সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো কঠোর তদারকি এবং বাধ্যতামূলক নিবন্ধনব্যবস্থা চালু করা, যেখানে প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) সতর্ক দৃষ্টির আওতায় কাজ করবে। এই দায়িত্ব পালনের জন্য একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক নিয়োগ করা যেতে পারে, যিনি শুধু এই খাতের তদারকির জন্য নিবেদিত থাকবেন। এর পাশাপাশি হয়রানি বন্ধ করতে একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল রেজিস্ট্রি এবং লাইসেন্সিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এই সিস্টেমে সব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হবে এবং তাদের লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন করতে হবে। এ ছাড়া নিরীক্ষা এবং পরিদর্শনের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হবে।

তদারকির পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শাসনকাঠামোতে আমূল সংস্কারের প্রয়োজন। যেসব হাসপাতালে ৫০টির বেশি শয্যা রয়েছে এবং বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর জন্য একটি ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। এই বোর্ডের নেতৃত্বে থাকবেন একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ। বোর্ডের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য হবেন নিবন্ধিত চিকিৎসক, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পেশাগত দক্ষতা প্রাধান্য পায়। তবে মালিকদের এই বোর্ডে সদস্য হওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না। এটি স্বার্থের সংঘাত রোধ করবে এবং নিশ্চিত করবে যে প্রতিষ্ঠানের লাভের আকাঙ্ক্ষা রোগীদের সেবার ওপর প্রভাব ফেলতে না পারে।

গুণগত মান নিশ্চিতকরণে ‘বাংলাদেশ হেলথ কমিশন’ (বিএইচসি) বা একটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রেডিং পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে। এই গ্রেড নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন মানদণ্ড বিবেচনা করা যেতে পারে। হাসপাতালের ক্ষেত্রে আইসিইউ ব্যবহারের হার, সংক্রমণের মাত্রা এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং রোগীর সন্তুষ্টির মাত্রা ইত্যাদি বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্যদিকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ক্ষেত্রে পরীক্ষার নির্ভুলতা, যন্ত্রপাতির সুরক্ষা এবং রিপোর্টিংয়ের মান বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎকর্ষের দিকে উৎসাহিত করবে। এটি রোগীদের জন্যও একটি বড় সুবিধা হবে, কারণ তাঁরা সচেতনভাবে বেছে নিতে পারবেন কোথায় তাঁরা সেবা নিতে চান। ফলে নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সামগ্রিক সেবার মান বাড়বে।

নৈতিকতা এবং পেশাগত উন্নয়নের বিষয়টিও অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। যেসব হাসপাতালে ২৫০টির বেশি শয্যা রয়েছে, সেখানে প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ করা যেতে পারে। এই প্রধানেরা ক্লিনিক্যাল নেতৃত্বকে শক্তিশালী করবেন এবং চিকিৎসা সিদ্ধান্তে পেশাদারি নিশ্চিত করবেন।

এ ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ‘কন্টিনিউয়িং মেডিকেল এডুকেশন’ (সিএমই) প্রোগ্রাম চালু করা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এই প্রোগ্রামগুলো চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জ্ঞান আপডেট রাখবে, তাঁদের দক্ষতা বাড়াবে এবং পেশার প্রতি তঁাদের নিযুক্তি বাড়াবে। এর পাশাপাশি কর্মীদের অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং ক্লান্তি থেকে রক্ষা করতে সেবা এবং ছুটির নীতিমালা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।

আর্থিক তদারকি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশিতেও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সেবার মূল্য সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী নির্ধারণ করা উচিত, যাতে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণযোগ্য হয়। হাসপাতালগুলোকে তাদের মোট শয্যার ১০ শতাংশ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে তাদের সেবার ৫ শতাংশ দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে প্রদান করতে হবে।

স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করতেও উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য কর্মীদের জন্য একটি জাতীয় মানসম্মত বেতনকাঠামো প্রণয়ন করা যেতে পারে। এটি ন্যায্য মজুরি, চাকরির নিরাপত্তা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। আর্থিক অনিশ্চয়তা কমে গেলে, হতাশা বা চাপ থেকে উদ্ভূত অনৈতিক চর্চার প্রবণতাও হ্রাস পাবে।

এটি শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়াবে না, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশের জন্যও স্বাস্থ্যসেবার দরজা খুলে দেবে। এ ছাড়া লাভের অংশীদারত্ব বা রেফারেলভিত্তিক চুক্তিগুলো সরকারের পর্যালোচনা এবং অনুমোদনের আওতায় আনা উচিত। এটি শোষণমূলক চর্চা কমাবে এবং জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবে।

চিকিৎসক এবং ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর মধ্যে সম্পর্কও গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। উপহার প্রদান, প্রচারমূলক প্রণোদনা বা প্রেসক্রিপশনের ওপর প্রভাব ফেলার মতো কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে নির্দেশিকা প্রণয়ন করা যেতে পারে। মেডিকেল সম্মেলন কেবল বাংলাদেশ মেডিকেল এডুকেশন অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের (বিএমইএসি) অনুমোদন সাপেক্ষে আয়োজন করা যাবে। মেডিকেল সম্মেলনগুলোতে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোকে শুধু প্রদর্শনী এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে যেন তাদের প্রভাব বৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তুতে না পড়ে।

‘ডুয়াল প্র্যাকটিস’–এর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচ বছরের মধ্যে পূর্ণকালীন চিকিৎসক জনবল কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ উন্নীত করতে হবে। ফলে হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি চিকিৎসকের বেকারত্ব কমবে।

স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করতেও উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য কর্মীদের জন্য একটি জাতীয় মানসম্মত বেতনকাঠামো প্রণয়ন করা যেতে পারে। এটি ন্যায্য মজুরি, চাকরির নিরাপত্তা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। আর্থিক অনিশ্চয়তা কমে গেলে, হতাশা বা চাপ থেকে উদ্ভূত অনৈতিক চর্চার প্রবণতাও হ্রাস পাবে।

পেশাজীবীদের আরও সুরক্ষা দিতে, চিকিৎসক, নার্স এবং টেকনিশিয়ানের জন্য বাধ্যতামূলক পেশাগত দায়বদ্ধতা বিমা চালু করা যেতে পারে। এটি তাঁদের অনিচ্ছাকৃত মেডিকেল ত্রুটিসংক্রান্ত আর্থিক ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে। এ ছাড়া মেডিকো-লিগ্যাল ক্ষেত্রে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। ফলে সেবার মান উন্নত হবে এবং রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

যখন কিছু ভুল হয়, রোগীদের তাদের অভিযোগ জানানোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও সহজলভ্য উপায় প্রয়োজন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) একটি ডিজিটাল অভিযোগ প্ল্যাটফর্ম দিয়ে শক্তিশালী করা যেতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রোগীরা তাঁদের অভিযোগ জমা দিতে পারবেন, যা তদন্ত এবং সমাধানের জন্য দ্রুত প্রক্রিয়া করা হবে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেল্পলাইন (১৬২৬৩) সম্প্রসারণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা যেতে পারে। এটি রোগীদের অভিযোগ ও পরামর্শ গ্রহণের জন্য একটি সহজ মাধ্যম হয়ে উঠবে। বিএমডিসি-কে আইনি ক্ষমতা প্রদান করা হলে তারা যাচাইকৃত অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত ও ন্যায্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

সবশেষে সরকার নৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে। ক্যানসার চিকিৎসা, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, দুর্লভ রোগের সেবা এবং উন্নত ডায়াগনস্টিকসে বিনিয়োগের জন্য করসুবিধা, বিশেষ আমদানি–সুবিধা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। এই প্রণোদনাগুলো উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে এবং জটিল রোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বাস্তবায়নের সুবিধার্থে এই বিষয়গুলোকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে হবে। তাই ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ সংশোধন করে একটি যুগোপযোগী ও স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই সমন্বিত ব্যবস্থা শুধু স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করবে না, বরং জনগণের মধ্যে আস্থা ও নির্ভরতা ফিরিয়ে আনবে।

  • ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)